ভারতে অনলাইন মানি-ভিত্তিক গেমসের (Online gaming income) উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে এবং এগুলিকে কার্যত নিষিদ্ধ করতে উভয় কক্ষের সংসদ সম্প্রতি ‘প্রোমোশন অ্যান্ড রেগুলেশন অফ অনলাইন গেমিং বিল, ২০২৫’ পাশ করেছে। এই বিল কার্যকর হলে অনলাইন মানি গেমস পরিচালনা, প্রচার ও বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হবে। সরকারের মতে, এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ক্রমবর্ধমান আসক্তি, মানি লন্ডারিং, সাইবার অপরাধ এবং আর্থিক প্রতারণা রোধ করার জন্য।
বিলটির লক্ষ্য হলো অনলাইন গেমিং খাতকে একটি সুস্পষ্ট আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা এবং অর্থ-ভিত্তিক গেমস বন্ধ করে শুধুমাত্র বিনোদনমূলক বা দক্ষতা-ভিত্তিক গেমগুলিকে অনুমোদন দেওয়া। অর্থাৎ, যেসব গেমে সরাসরি অর্থ বিনিয়োগ বা জেতার সুযোগ থাকে, সেগুলি আর চালু রাখা যাবে না।
কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সংসদে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, “অর্থ-ভিত্তিক অনলাইন গেমস সমাজে এক ধরনের আসক্তি তৈরি করছে। এর ফলে সাধারণ পরিবারে আর্থিক ক্ষতি, ঋণের বোঝা এবং মানসিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়ছে। তাই এই খাতকে অবিলম্বে নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি।”
সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছে, অনলাইন গেমিং থেকে FY 2024-25 অর্থবর্ষে যেকোনও আয় বা ক্ষতি হলে তা আয়কর রিটার্নে (ITR) উল্লেখ করতে হবে। অনলাইন গেম থেকে অর্জিত আয়কে “অন্যান্য উৎস থেকে আয়” (Income from Other Sources) হিসেবে গণ্য করা হয়।
ধারা 115BBJ অনুসারে, অনলাইন গেমিং থেকে অর্জিত নিট আয়ের উপর সরাসরি ৩০% হারে আয়কর আরোপ করা হবে।
ধারা 194BA অনুসারে, কর কর্তন (TDS) একই হারে করা হবে এবং তা আর্থিক বছরের শেষে সংশ্লিষ্ট গেমিং অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া নিট আয়ের উপর কেটে নেওয়া হবে।
কর বিশেষজ্ঞ সিএ শেফালি মুন্দ্রা (Clear Tax) বলেন, “যদি কেউ অনলাইন গেমিংয়ের মাধ্যমে আয় করে থাকেন, তবে তা অবশ্যই আয়কর রিটার্নে দেখাতে হবে। আয়কর আইন অনুসারে, এই আয়ের উপর ৩০% হারে কর দিতে হবে। ইতিমধ্যেই কেটে নেওয়া TDS আপনার ফর্ম 26AS-এ দেখা যাবে এবং ITR-এ Schedule TDS অংশে তা প্রতিফলিত করতে হবে।”
তিনি আরও জানান, গেমিংয়ে ক্ষতি হলে তা একই উৎস থেকে আয়ের সঙ্গে সমন্বয় করা যেতে পারে, তবে অন্য কোনও আয়ের সঙ্গে মিলিয়ে ক্ষতি সমন্বয় করা যাবে না।
‘আয় অন্যান্য উৎস থেকে’ কী?
ভারতের আয়কর আইনে আয়ের পাঁচটি প্রধান উৎস ধরা হয়—
1. বেতন (Salary)
2. ব্যবসা বা পেশা (Business or Profession)
3. বাড়ি থেকে আয় (House Property)
4. মূলধন লাভ (Capital Gains)
5. অন্যান্য উৎস (Other Sources)
‘অন্যান্য উৎস থেকে আয়’-এর মধ্যে এমন সব আয় পড়ে যা অন্য চারটি বিভাগের মধ্যে ফেলা যায় না। যেমন: লটারিতে জেতা অর্থ, উপহার, বর্ধিত ক্ষতিপূরণের উপর সুদ ইত্যাদি। নতুন আইনের আওতায় অনলাইন গেমিং থেকেও অর্জিত অর্থ এই শ্রেণির মধ্যে পড়বে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতে অনলাইন গেমিং দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মোবাইল অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইন লুডো, রামি, পোকার, ফ্যান্টাসি ক্রিকেট ইত্যাদি খেলে অর্থ বিনিয়োগের প্রবণতা বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে খেলোয়াড়রা বড় অঙ্কের টাকা হারাচ্ছেন, ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন এমনকি আত্মহত্যার মতো চরম পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
বিভিন্ন রাজ্য সরকারও পূর্বে এই খাতের উপর বিধিনিষেধ আরোপের চেষ্টা করেছে। তবে সর্বভারতীয় স্তরে একটি একক আইন না থাকায় অনলাইন গেমিং সংস্থাগুলি আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল। এবার কেন্দ্র সরকার স্পষ্টভাবে এই খাতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় সেই সুযোগ বন্ধ হবে।
বিলটি সংসদে পাশ হলেও এর বিরুদ্ধে কিছু মতবিরোধ উঠেছে। বিরোধী দলগুলির একটি অংশের মতে, হঠাৎ করে অনলাইন মানি গেম নিষিদ্ধ করলে আইটি শিল্পের ক্ষতি হবে এবং হাজার হাজার তরুণ তাদের চাকরি হারাবেন।
তাদের মতে, সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার বদলে কঠোর লাইসেন্সিং ব্যবস্থা চালু করা উচিত ছিল। এর মাধ্যমে সরকারের কর রাজস্বও আসত এবং একই সঙ্গে আসক্তির ঝুঁকিও কমানো যেত।
তবে সরকার স্পষ্ট করেছে, এই বিল সাধারণ অনলাইন গেমিং বা ই-স্পোর্টসকে প্রভাবিত করবে না। কেবলমাত্র টাকা লেনদেন-ভিত্তিক গেমসের উপরই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে।
সাধারণ মানুষ এবং অভিভাবকদের একাংশ সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের মতে, তরুণ প্রজন্ম ক্রমশ ভার্চুয়াল গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছিল, যা পড়াশোনা ও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করছিল।
একজন অভিভাবক বলেন, “আমার ছেলে রাত জেগে অনলাইন ফ্যান্টাসি ক্রিকেট খেলত। অনেক টাকা খরচ করেছে। এখন যদি এগুলো নিষিদ্ধ হয়, তাহলে অন্তত এই আসক্তি থেকে মুক্তি পাবে।”
অন্যদিকে, যারা অনলাইন গেমিংয়ে নিয়মিত আয় করছিলেন, তাদের কাছে এটি বড় ধাক্কা। অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন— সরকার কি বিকল্প বিনোদন বা আয়ের সুযোগ তৈরি করবে?
‘প্রোমোশন অ্যান্ড রেগুলেশন অফ অনলাইন গেমিং বিল, ২০২৫’ কার্যকর হলে ভারতের অনলাইন মানি গেমস শিল্পে বড় পরিবর্তন আসবে। অর্থ বিনিয়োগ করে খেলার সুযোগ বন্ধ হবে, ফলে একদিকে আর্থিক প্রতারণা ও আসক্তি কমবে, অন্যদিকে একটি বড় ব্যবসায়িক খাত সংকটে পড়বে।
তবে সরকারের দাবি, এই কঠিন সিদ্ধান্ত সমাজের সামগ্রিক স্বার্থে নেওয়া হয়েছে। এখন দেখা যাবে, বিল কার্যকর হওয়ার পর অনলাইন গেমিং খাত কোন পথে এগোয় এবং সাধারণ মানুষের জীবন কতটা বদলায়।