ভারতের পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) ব্যবস্থায় ভুয়া ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট (আইটিসি) দাবির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে ভুয়া আইটিসি (ITC Scam) দাবির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫,৮৫১ কোটি টাকায়, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৯ শতাংশ বেশি। এই তথ্য পিটিআই সূত্রে জানা গেছে এবং এতে উদ্বেগ বেড়েছে কর প্রশাসনের অন্দরমহলে।
কমেছে ভুয়া সংস্থার সংখ্যা, কিন্তু বেড়েছে প্রতারণার পরিমাণ:
গত বছরের তুলনায় এই সময়ে শনাক্ত হওয়া ভুয়া সংস্থার সংখ্যা কিছুটা কমেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে যেখানে ৩,৮৪০টি ভুয়া সংস্থা চিহ্নিত হয়েছিল, চলতি বছর সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩,৫৫৮-এ। এই তথ্য অনুযায়ী, জিএসটি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে পরিচালিত ফিকটিশিয়াস রেজিস্ট্রেশনের বিরুদ্ধে অভিযান কিছুটা সাফল্য পেয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
একজন সরকারি আধিকারিক বলেন, “ভুয়া সংস্থার সংখ্যা কমছে, যা দেখায় যে ভুয়া জিএসটি রেজিস্ট্রেশনের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপ কার্যকর হয়েছে। তবে প্রতারণার পরিমাণ এবং প্রকৃতি আরও জটিল হচ্ছে।”
বড় প্রতারণা, ছোট সংখ্যক সংস্থা: চ্যালেঞ্জ বাড়ছে:
সংখ্যায় কম হলেও, ভুয়া সংস্থাগুলোর প্রতারণার পরিমাণ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুন ত্রৈমাসিকে ৫৩ জনকে গ্রেফতার করেছে জিএসটি আধিকারিকরা এবং ₹৬৫৯ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে। তুলনামূলকভাবে, গত বছরের একই সময়ে ২৬ জন গ্রেফতার হয়েছিল এবং ₹৫৪৯ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছিল। এই পরিসংখ্যান দেখায় যে, এখন কম সংস্থা দ্বারা হলেও বড় অঙ্কের প্রতারণা করা হচ্ছে।
২০২৫ অর্থবছরে এখনো পর্যন্ত মোট ২৫,০০৯টি ভুয়া সংস্থা শনাক্ত হয়েছে, যারা সম্মিলিতভাবে ৬১,৫৪৫ কোটি টাকার আইটিসি প্রতারণা করেছে বলে জানা গিয়েছে।
কীভাবে হয় এই প্রতারণা?
জিএসটি ব্যবস্থায় ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট (আইটিসি) ব্যবসায়ীদের সেই করের উপর ছাড় দেয়, যা তারা কাঁচামাল বা ইনপুট কেনার সময় প্রদান করেছে। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভুয়া ইনভয়েস দেখিয়ে এমন করের ছাড় দাবি করে, যা আদতে কখনো দেওয়া হয়নি। এর ফলে সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে।
এই ধরণের প্রতারণা ঠেকাতে একাধিক সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবুও কিছু অসাধু গোষ্ঠী কৃত্রিম সংস্থা খুলে, ভুয়া ইনভয়েস তৈরি করে ও অবৈধভাবে আইটিসি দাবি করে সরকারকে প্রতারিত করছে।
কঠোর যাচাই-বাছাই ও রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ার সংস্কার:
এই ধরনের প্রতারণা রুখতে জিএসটি রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়া আরও কঠোর করা হয়েছে। সন্দেহভাজন আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে ফিজিক্যাল ভেরিফিকেশন ও আধার ভিত্তিক যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যেসব ব্যবসা সত্যিই বৈধ, তারা মাত্র ৭ দিনের মধ্যেই রেজিস্ট্রেশন পায়, কিন্তু সন্দেহজনক ক্ষেত্রে বিস্তারিত তদন্ত করা হয়।
জিএসটি আইন অনুযায়ী, এই ধরনের প্রতারণা রুখতে রেজিস্ট্রেশন সাময়িকভাবে স্থগিত করা যায়, আইটিসি ব্লক করে রাখা যায়, সম্পত্তি আটক করা যায়, এমনকি অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করেও শাস্তি দেওয়া যায়।
রাজ্য অর্থমন্ত্রীদের গোষ্ঠীর তৎপরতা:
ভুয়া আইটিসি প্রতারণা রুখতে রাজ্য অর্থমন্ত্রীদের একটি গোষ্ঠী, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী প্রমোদ সাওয়ান্ত, ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সেক্টরভিত্তিক কর ফাঁকির ধরণ বিশ্লেষণ করছেন। এই গোষ্ঠী জিএসটি কাউন্সিলকে আরও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে।
জিএসটি কাউন্সিলের এক সদস্য বলেন, “ভুয়া আইটিসি দাবির মাধ্যমে যারা রাজস্ব প্রতারণা করছে, তাদের ধরতে আমাদের তথ্য বিশ্লেষণ পদ্ধতি আরও উন্নত করতে হবে এবং সেক্টরভিত্তিক ঝুঁকি মূল্যায়নের পদ্ধতি চালু করতে হবে।”
জিএসটি ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল সহজ, স্বচ্ছ এবং কার্যকর কর আদায়ের পদ্ধতি চালু করা। কিন্তু ভুয়া সংস্থার মাধ্যমে আইটিসি দাবির জাল বিস্তার করায় এই ব্যবস্থার উপর আস্থা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি দপ্তরগুলির সক্রিয়তা, কড়া তদন্ত ও সংস্কারের পদক্ষেপ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আশার সঞ্চার করেছে।
সরকারের উচিত প্রযুক্তিনির্ভর তত্ত্বাবধান, রিয়েল-টাইম ডেটা অ্যানালিটিকস এবং কড়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে এই ধরনের প্রতারণাকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা। নয়তো, স্বচ্ছ কর ব্যবস্থার স্বপ্ন থেকে যাবে কেবল কাগজে কলমে।