২০২৫ সালে ব্যাংকের সেভিংস অ্যাকাউন্টে (Savings Account ) টাকা রেখে দেওয়া মানে রোদে বরফ রেখে দেওয়ার মতোই। অর্থাৎ, আপনার টাকা ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে এবং এর আসল মূল্য কমে যাচ্ছে। এই কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট নিতিন কৌশিক। তিনি বলেন, ‘‘অনেকে বলেন, ‘ব্যাংকে তো আমার টাকা নিরাপদ।’ কিন্তু যদি তা বাড়তে না থাকে, তাহলে সেটা কমছে। যা নিরাপত্তা মনে হয়, তা আসলে ধীরে ধীরে আর্থিক ক্ষয়।’’
ভারতের বেশিরভাগ মানুষ surplus fund বা অতিরিক্ত টাকা সেভিংস অ্যাকাউন্টে রেখে দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ এটাকে অনেকেই নিরাপদ এবং সহজ উপায় বলে মনে করেন। কিন্তু অর্থ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ‘নিরাপত্তার বোধ’ আড়ালে বড় আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ কম সুদের হার এবং ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি মিলে আপনার টাকার প্রকৃত মূল্য কমিয়ে দেয়।
সেভিংস অ্যাকাউন্টের স্বল্প সুদের হার:
ভারতের সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলির সেভিংস অ্যাকাউন্টের সুদের হার অত্যন্ত কম। উদাহরণস্বরূপ, স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (SBI) দেয় মাত্র ২.৫%। এইচডিএফসি, আইসিআইসিআই ও অ্যাক্সিস ব্যাংকের মতো বেসরকারি ব্যাংকগুলি দেয় গড়ে ২.৭৫%। IDFC First Bank তুলনামূলকভাবে বেশি দেয়, কিন্তু সেটিও ৩% এর বেশি নয়।
নিতিন কৌশিক ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘‘আপনার এক লক্ষ টাকা মাসে পানিপুরি খাওয়ার খরচের চেয়েও কম সুদ এনে দিচ্ছে। এটা সেভিং নয়, এটা হলো ধীরে ধীরে নিজেকে আর্থিকভাবে শেষ করা।’’
মূল্যবৃদ্ধির অদৃশ্য ঘাতক:
ভারতের গড় মূল্যবৃদ্ধির হার ৫–৬%। অর্থাৎ, আপনার টাকার ক্রয়ক্ষমতা প্রতি বছর কমছে। কৌশিক বলেন, ‘‘যদি আপনি ২.৭% সুদ পান এবং মূল্যবৃদ্ধি ৬% হয়, তাহলে আপনার টাকা আসলে প্রতিদিন কিছুটা করে কমছে। আজকের ১০০ টাকা এক বছরের পর ৯৪ টাকার সমান হবে।’’
অলস টাকা মানে হারানো সুযোগ:
কৌশিকের মতে, অলস টাকা মানে অকার্যকর কর্মচারীর মতো। ‘‘আপনি কি কাউকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে চান? তাহলে কেন আপনার টাকা কোনো কাজ ছাড়া বসিয়ে রাখবেন? আপনার টাকাকেও ‘হাসল’ করতে হবে, অর্থাৎ বেশি টাকা আনার জন্য পরিশ্রম করতে হবে।’’
তিনি পরামর্শ দেন, দৈনন্দিন বা জরুরি খরচের জন্য ৩ থেকে ৬ মাসের প্রয়োজনীয় অর্থ সেভিংস অ্যাকাউন্টে রাখা যেতে পারে। বাকি অতিরিক্ত অর্থ অবশ্যই বেশি রিটার্ন দেওয়া কোনো বিকল্পে বিনিয়োগ করা উচিত।
সেভিংস অ্যাকাউন্টের বিকল্প:
অতি রক্ষণশীল বিনিয়োগকারীদের জন্য যাঁরা শেয়ারবাজারের ওঠানামা পছন্দ করেন না, তাঁদের জন্য কিছু নিরাপদ এবং উচ্চ-ফলনশীল বিকল্প রয়েছে—
লিকুইড মিউচুয়াল ফান্ড: গড়ে প্রায় ৬.৯২% রিটার্ন দেয়। এগুলি কর-সাশ্রয়ী এবং সহজে নগদায়নযোগ্য।
ওভারনাইট ফান্ড: কয়েক দিনের জন্য টাকা রাখার আদর্শ বিকল্প। গত বছরে প্রায় ৬.৩৩% রিটার্ন দিয়েছে।
শর্ট-টার্ম ডেট ফান্ড: লিকুইড ফান্ডের চেয়ে কিছুটা বেশি রিটার্ন দেয়, তবুও স্থিতিশীল।
RBI ফ্লোটিং রেট বন্ড: সরকারি গ্যারান্টি-যুক্ত, নিরাপদ।
ফিক্সড ডিপোজিট (FD): খুব রক্ষণশীলদের জন্য এখনও উপযুক্ত, যদিও রিটার্ন মাঝারি।
লিকুইড ফান্ডের বিশেষ সুবিধা:
লিকুইড ফান্ড সেভিংস অ্যাকাউন্টের অন্যতম সেরা বিকল্প। এখানে ৯১ দিনের মধ্যে পরিপক্ব হওয়া উচ্চ-মানের ঋণপত্রে বিনিয়োগ করা হয়। এতে ঝুঁকি কম এবং অল্প সময়ের জন্যও ব্যবহার করা যায়।
এই ফান্ডে কোনো ন্যূনতম ব্যালান্সের প্রয়োজন নেই। সহজে টাকা তুলে নেওয়া যায়। দুপুর ৩:৩০-এর আগে রিডেম্পশন করলে পরের দিন সকাল ১০টার মধ্যে টাকা ক্রেডিট হয়ে যায়। শুক্রবার রিডেম্পশন করলে সোমবার ক্রেডিট হয়।
সাধারণত ৭ দিন থেকে ৩ মাসের জন্য এই ফান্ড উপযুক্ত। ৭ দিনের মধ্যে টাকা তুললে খুব সামান্য exit load (প্রায় ০.০০৭০% থেকে ০.০০৪৫%) কেটে নেওয়া হয়।
ছোট পরিমাণেও শুরু করুন:
কৌশিকের মতে, ‘‘আপনি কত টাকা দিয়ে শুরু করছেন, সেটাই বড় কথা নয়। নিয়মিত বিনিয়োগ করাই গুরুত্বপূর্ণ। মাসে মাত্র ৫০০ টাকা নিয়মিত বিনিয়োগ করলেও, তা সময়ের সাথে সাথে বড় সঞ্চয়ে পরিণত হতে পারে।’’ নিতিন কৌশিক বলেন, ‘‘ব্যাংকের সেভিংস অ্যাকাউন্ট নিরাপদ, কিন্তু ধীর। আসল চোর হলো মূল্যবৃদ্ধি। টাকা বসিয়ে না রেখে কাজে লাগান।’’
২০২৫-এ সঠিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা মানে হলো সেভিংস অ্যাকাউন্টের মিথ্যা আরাম ছেড়ে বেরিয়ে আসা। ছোট পরিমাণ হলেও নিয়মিতভাবে এবং বুদ্ধিমানের মতো বিনিয়োগ করলে দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।