কলকাতা একসময় তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং শিক্ষাগত উৎকর্ষের জন্য পরিচিত ছিলেন, এখন ভারতের উদীয়মান প্রযুক্তি কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। পশ্চিমবঙ্গের ‘বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি’ প্রকল্প এবং রাজ্য সরকারের ব্যবসা-বান্ধব নীতিগুলোর ফলে কলকাতায় আইটি শিল্প দ্রুত বিকাশ লাভ করছে। এই প্রযুক্তি বিপ্লবের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো মহিলা পেশাদারদের (Women in IT) ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ। ২০২৫ সালে কলকাতার আইটি সংস্থাগুলোতে মহিলারা শুধু কর্মী হিসেবে নয়, নেতৃত্বের ভূমিকায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করব কীভাবে মহিলা পেশাদাররা কলকাতার প্রযুক্তি খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং লিঙ্গ সমতা (gender equality) প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখছেন।
কলকাতার আইটি খাতে মহিলাদের উত্থান
ভারতের আইটি শিল্পে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, এবং কলকাতাও এর ব্যতিক্রম নয়। ৪৫১ রিসার্চের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের আইটি শিল্পে মহিলাদের অংশগ্রহণ বর্তমানে ৩৪% এ পৌঁছেছে, যা পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য। কলকাতায়, টিসিএস, উইপ্রো, কগনিজেন্ট, এবং ইনফোসিসের মতো বড় সংস্থাগুলোর পাশাপাশি ওয়াও! মোমো, সাস্তাসুন্দর, এবং স্টকএজের মতো স্টার্টআপগুলোতে মহিলা পেশাদাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এই মহিলারা শুধু প্রযুক্তিগত দক্ষতাই প্রদর্শন করছেন না, বরং নেতৃত্ব, উদ্ভাবন, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন।
মহিলাদের এই অগ্রগতির পেছনে রয়েছে শিক্ষাগত উৎকর্ষ। কলকাতার আইআইটি খড়্গপুর, জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর প্রচুর সংখ্যক মহিলা প্রকৌশলী এবং প্রযুক্তি স্নাতক তৈরি হচ্ছেন। তবে, শিক্ষার পাশাপাশি, কলকাতার আইটি সংস্থাগুলোতে মহিলাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ, যেমন মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম, নমনীয় কাজের সময়, এবং মাতৃত্বকালীন সুবিধা, তাদের কর্মজীবনে সাফল্য অর্জনে সহায়তা করছে।
নেতৃত্বে মহিলা: কলকাতার উদাহরণ
কলকাতার আইটি খাতে মহিলা নেতৃত্বের উদাহরণ হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি সোনালী গুপ্তার মতো ব্যক্তিত্বকে। সোনালী, যিনি আপস্কিলিস্টের ডিরেক্টর অফ ইঞ্জিনিয়ারিং, ভারতের প্রযুক্তি খাতে মহিলাদের জন্য একটি পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, “মহিলাদের প্রযুক্তি খাতে প্রবেশ এবং নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য মেন্টরশিপ এবং সিনিয়র নেতৃত্বের সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” তাঁর মতো অনেক মহিলা প্রযুক্তি খাতে লিঙ্গ সমতার জন্য কাজ করছেন এবং অন্য মহিলাদের জন্য পথ দেখাচ্ছেন।
কলকাতার স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমেও মহিলা উদ্যোক্তারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছেন। উদাহরণস্বরূপ, ওয়াও! মোমো, যা ২০১৯ সালে টাইগার গ্লোবালের কাছ থেকে ২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে, মহিলাদের নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। এই স্টার্টআপগুলোতে মহিলা নেতৃত্ব শুধু ব্যবসায়িক সাফল্যই নয়, বরং কর্মীদের জন্য একটি সমর্থনমূলক পরিবেশ তৈরি করছে।
লিঙ্গ সমতার জন্য উদ্যোগ
কলকাতায় লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য বেশ কয়েকটি সংস্থা এবং উদ্যোগ কাজ করছে। ‘উইমেন ইন টেক ইন্ডিয়া’ এবং ‘লিন ইন উইমেন ইন টেক ইন্ডিয়া’র মতো সংগঠনগুলো মহিলাদের জন্য মেন্টরশিপ, নেটওয়ার্কিং, এবং দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ প্রদান করছে। এই সংগঠনগুলো মহিলাদের প্রযুক্তি খাতে প্রবেশ এবং টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন প্রদান করছে। উদাহরণস্বরূপ, উইমেন ইন টেক ইন্ডিয়া মহিলাদের জন্য স্কলারশিপ এবং ফেলোশিপ প্রোগ্রাম চালু করেছে, যা তরুণীদের প্রযুক্তি শিক্ষায় উৎসাহিত করছে।
এছাড়া, কলকাতার আইটি সংস্থাগুলো মহিলাদের জন্য বিশেষ নীতি প্রণয়ন করছে। উদাহরণস্বরূপ, এইচসিএল টেকনোলজিসের ‘আইবিলিভ’ উদ্যোগ মহিলাদের জন্য দ্বিতীয় ক্যারিয়ার প্রোগ্রাম চালু করেছে, যা ক্যারিয়ার বিরতির পর মহিলাদের পুনরায় কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসতে সহায়তা করে। এই ধরনের উদ্যোগ মহিলাদের কর্মজীবনে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করছে।
চ্যালেঞ্জসমূহ
যদিও কলকাতার আইটি খাতে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ম্যাককিন্সির একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, মহিলাদের প্রযুক্তি খাতে প্রবেশ এবং টিকে থাকার পথে লিঙ্গ বৈষম্য, কর্ম-জীবনের ভারসাম্য, এবং সিনিয়র নেতৃত্বে সীমিত প্রতিনিধিত্ব বড় বাধা। কলকাতায়, বিশেষ করে, মহিলাদের প্রায়শই পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রের দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়, যা তাদের ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলে। এছাড়া, স্টার্টআপগুলোতে মহিলা উদ্যোক্তাদের জন্য তহবিল সংগ্রহে অসুবিধা এবং পুরুষ-প্রধান কর্মসংস্কৃতি এখনও একটি সমস্যা।
কলকাতায় মহিলাদের সাফল্যের গল্প
কলকাতার আইটি খাতে মহিলাদের সাফল্যের বেশ কিছু উদাহরণ রয়েছে। শ্রীবিদ্যা কান্নান, অভালি সলিউশনসের প্রতিষ্ঠাতা, বলেন, “মহিলাদের প্রযুক্তি খাতে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন এবং সুযোগ প্রদান করা গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি মহিলাদের জন্য একটি সমর্থনমূলক কর্মপরিবেশ তৈরির উপর জোর দেন। এছাড়া, কলকাতার স্টার্টআপ সাস্তাসুন্দরের মতো সংস্থাগুলো মহিলাদের নেতৃত্বে এবং কর্মী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
লিঙ্গ সমতার গুরুত্ব
লিঙ্গ সমতা শুধুমাত্র নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্যও অপরিহার্য। ম্যাককিন্সির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, লিঙ্গ বৈচিত্র্যযুক্ত সংস্থাগুলো ১৫% বেশি মুনাফা অর্জন করে এবং উদ্ভাবনী সমাধান প্রদানে সক্ষম হয়। কলকাতার আইটি সংস্থাগুলো এই সুবিধা গ্রহণ করছে এবং মহিলাদের জন্য আরও সমর্থনমূলক পরিবেশ তৈরি করছে। মহিলাদের দৃষ্টিভঙ্গি পণ্য উন্নয়নে এবং বাজারের চাহিদা বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা সংস্থাগুলোর প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা বাড়ায়।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
কলকাতার আইটি খাতে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে শিক্ষা, মেন্টরশিপ, এবং নীতিগত সংস্কারের উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ে মেয়েদের এসটিইএম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, এবং গণিত) শিক্ষায় উৎসাহিত করা, মহিলাদের জন্য কোডিং বুটক্যাম্প এবং প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা, এবং কর্মক্ষেত্রে নমনীয় নীতি প্রণয়ন করা গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতার স্টার্টআপ এবং আইটি সংস্থাগুলো যদি এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে, তবে শহরটি ভারতের প্রযুক্তি খাতে একটি লিঙ্গ-সমতাযুক্ত কেন্দ্র হিসেবে উঠে আসতে পারে।
কলকাতার আইটি খাতে মহিলা পেশাদাররা তাদের দক্ষতা, নেতৃত্ব, এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে শহরের প্রযুক্তি ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করছেন। সোনালী গুপ্তা এবং শ্রীবিদ্যা কান্নানের মতো নেতৃরা অন্য মহিলাদের জন্য পথ দেখাচ্ছেন, এবং উইমেন ইন টেক ইন্ডিয়ার মতো সংগঠনগুলো মহিলাদের সমর্থন করছে। যদিও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, তবে সঠিক নীতি এবং সমর্থনের মাধ্যমে কলকাতা ভারতের আইটি খাতে লিঙ্গ সমতার একটি উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে। মহিলাদের এই অগ্রগতি কেবল প্রযুক্তি খাতের জন্যই নয়, বরং সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।