ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাত গত কয়েক দশকে দেশের অর্থনীতির একটি প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। তবে, এই খাতের প্রবৃদ্ধি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ, চেন্নাই এবং পুনে-র মতো দক্ষিণ ভারতের শহরগুলি আইটি শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেও, কলকাতার আইটি খাত (Kolkata IT Sector) এখনও এই শহরগুলির তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী হিসেবে কলকাতার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও শিল্প ঐতিহ্য থাকলেও, আইটি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটি দক্ষিণ ভারতের তুলনায় ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এই আঞ্চলিক বৈষম্যের পিছনে রয়েছে একাধিক কারণ, যা কলকাতার আইটি খাতের সম্ভাবনাকে সীমিত করছে।
ঐতিহাসিক ও অবকাঠামোগত পার্থক্য
দক্ষিণ ভারতের শহরগুলি, বিশেষ করে বেঙ্গালুরু এবং হায়দ্রাবাদ, ১৯৯০-এর দশক থেকে আইটি শিল্পে বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক গুরুত্ব পেয়েছে। বেঙ্গালুরু, যিনি ভারতের ‘সিলিকন ভ্যালি’ নামে পরিচিত, টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (টিসিএস), ইনফোসিস এবং উইপ্রোর মতো বড় আইটি সংস্থাগুলির সদর দপ্তর হিসেবে গড়ে উঠেছে। হায়দ্রাবাদের হাইটেক সিটি এবং চেন্নাইয়ের আইটি করিডরও বহুজাতিক সংস্থাগুলির জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। এই শহরগুলিতে সরকারী নীতি, ট্যাক্স ছাড়, এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) তৈরির মাধ্যমে আইটি শিল্পকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
Also Read | অভয়ার জন্য বিচার চেয়ে এবার বিপাকে শ্রীলেখা
অন্যদিকে, কলকাতার আইটি খাতের বিকাশ তুলনামূলকভাবে দেরিতে শুরু হয়। ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে সল্টলেকের সেক্টর-৫ এবং রাজারহাটের নিউ টাউন এলাকায় আইটি হাব গড়ে ওঠা শুরু হয়। টিসিএস, কগনিজেন্ট, এবং উইপ্রোর মতো কিছু বড় সংস্থা এখানে তাদের কার্যালয় স্থাপন করলেও, এই উদ্যোগগুলি দক্ষিণ ভারতের তুলনায় অনেক ছোট পরিসরে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আইটি খাতে বিনিয়োগের প্রচেষ্টা থাকলেও, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং নীতিগত সংস্কারে ধীরগতি কলকাতার প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি
দক্ষিণ ভারতের শহরগুলিতে প্রকৌশল শিক্ষার জন্য বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেমন বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি) এবং হায়দ্রাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (আইআইটি)। এই প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার দক্ষ প্রকৌশলী আইটি শিল্পে যোগ দিচ্ছেন। তবে, কলকাতায় যদিও জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইআইটি খড়্গপুরের মতো নামকরা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তবুও আইটি শিল্পের চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ পেশাদার তৈরি হচ্ছে না। এছাড়া, কলকাতার অনেক তরুণ প্রকৌশলী বেঙ্গালুরু বা হায়দ্রাবাদের মতো শহরে চাকরির সুযোগের জন্য পাড়ি জমাচ্ছেন, যা স্থানীয় আইটি খাতের মানবসম্পদের ঘাটতিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
Also Read | ‘বাংলা শিল্পবিরোধী নয়’, কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেন শশী পাঁজা
নীতিগত ও রাজনৈতিক বাধা
দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি, যেমন কর্নাটক এবং তেলেঙ্গানা, আইটি শিল্পের জন্য সহায়ক নীতি এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ প্রদান করেছে। বিপরীতে, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। যদিও তৃণমূল কংগ্রেস সরকার আইটি খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট, তবুও জমি অধিগ্রহণ এবং প্রশাসনিক জটিলতার মতো সমস্যাগুলি বিনিয়োগকারীদের পিছিয়ে দিয়েছে।
আঞ্চলিক বৈষম্য এবং বাজারের আকর্ষণ
দক্ষিণ ভারতের শহরগুলি বিশ্বব্যাপী আইটি বাজারে একটি শক্তিশালী উপস্থিতি গড়ে তুলেছে। বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত সংস্থাগুলি শুধু ভারতীয় বাজারের জন্য নয়, বৈশ্বিক ক্লায়েন্টদের জন্যও সেবা প্রদান করে। হায়দ্রাবাদের মাইক্রোসফট এবং গুগলের মতো বহুজাতিক সংস্থাগুলির উপস্থিতি এই অঞ্চলের আকর্ষণকে আরও বাড়িয়েছে। কলকাতায়, যদিও কিছু বড় সংস্থা রয়েছে, তবে তাদের কার্যক্রমের পরিধি তুলনামূলকভাবে ছোট। এছাড়া, দক্ষিণ ভারতের শহরগুলির তুলনায় কলকাতায় স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম এবং উদ্ভাবন কেন্দ্রের অভাব রয়েছে।
কলকাতার সম্ভাবনা
তবে, কলকাতার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য নয়। রাজ্য সরকারের নতুন আইটি নীতি এবং সিলিকন ভ্যালি প্রকল্পের মাধ্যমে কলকাতাকে একটি আইটি হাব হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছে। নিউ টাউন এবং সল্টলেকের আইটি পার্কগুলিতে ছোট এবং মাঝারি সংস্থাগুলি ধীরে ধীরে বাড়ছে। এছাড়া, কলকাতার জীবনযাত্রার কম খরচ এবং প্রতিভাবান তরুণ জনশক্তি এই শহরকে বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় করতে পারে।
কলকাতার আইটি খাতের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে হলে সরকারকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়ন, দ্রুত জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া, এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির উপর জোর দিতে হবে। এছাড়া, স্টার্টআপ এবং উদ্ভাবন কেন্দ্র গড়ে তোলার মাধ্যমে কলকাতা দক্ষিণ ভারতের শহরগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারে।