বর্তমান সময়ে কলকাতার স্টার্টআপগুলো কেন প্রতিভা ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে?

পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে কলকাতা গত এক দশকে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে (West Bengal’s Startup Ecosystem) উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। ‘বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি’ প্রকল্প, সরকারি উদ্যোগ যেমন স্টার্টআপ…

Challenges in West Bengal’s Startup Ecosystem

পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে কলকাতা গত এক দশকে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে (West Bengal’s Startup Ecosystem) উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। ‘বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি’ প্রকল্প, সরকারি উদ্যোগ যেমন স্টার্টআপ বেঙ্গল, এবং টিসিএস, উইপ্রো, এবং কগনিজেন্টের মতো বড় আইটি সংস্থাগুলোর উপস্থিতি কলকাতাকে ভারতের উদীয়মান স্টার্টআপ হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে, ২০২৫ সালে এসে কলকাতার স্টার্টআপগুলো একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে—প্রতিভা ধরে রাখার ক্ষেত্রে অক্ষমতা। কর্মীদের উচ্চ হারে চাকরি ছাড়ার সমস্যা (employee turnover) পশ্চিমবঙ্গের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের বৃদ্ধির পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই সমস্যার কারণ, প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।

কর্মী ছাড়ার সমস্যা: কলকাতার স্টার্টআপগুলোর বাস্তবতা
কলকাতার স্টার্টআপগুলোতে কর্মীদের টার্নওভার রেট বেশি থাকার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। টিআইই কলকাতার চেয়ারম্যান অভিষেক রুঙ্গটা জানিয়েছেন, “ভালো প্রতিভা ছাড়া ভালো ব্যবসা গড়ে তোলা সম্ভব নয়, কিন্তু ভালো সংস্থা না থাকলে প্রতিভাও থেকে যায় না।” এটি একটি দুষ্টচক্র, যেখানে প্রতিভা এবং ব্যবসার বৃদ্ধি একে অপরের উপর নির্ভরশীল। ২০২৫ সালে কলকাতার স্টার্টআপগুলোর মধ্যে প্রায় ২৫-৩০% কর্মী প্রতি বছর চাকরি ছেড়ে যাচ্ছেন, যা জাতীয় গড়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।

   

প্রতিভা ধরে রাখতে ব্যর্থতার কারণ
১. প্রতিভা পলায়ন (Brain Drain): কলকাতার অনেক তরুণ প্রযুক্তি পেশাদার বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ, গুরুগ্রাম বা দিল্লির মতো শহরে চলে যাচ্ছেন, যেখানে বেশি বেতন, ভালো কাজের পরিবেশ, এবং ক্যারিয়ার বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। টিআইই কলকাতার অভিষেক রুঙ্গটা উল্লেখ করেছেন, দিল্লি এনসিআর, মুম্বই এবং বেঙ্গালুরুর স্টার্টআপগুলোতে কর্মরত অনেক প্রতিভা মূলত পশ্চিমবঙ্গের। এই প্রতিভা পলায়ন কলকাতার স্টার্টআপগুলোর জন্য একটি বড় ক্ষতি।

২. সীমিত তহবিল ও বিনিয়োগ: কলকাতার স্টার্টআপগুলো বেঙ্গালুরু বা মুম্বইয়ের তুলনায় কম ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এবং এঞ্জেল ইনভেস্টরদের আকর্ষণ করে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কলকাতার স্টার্টআপগুলো মাত্র ৪৩.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে, যা বেঙ্গালুরুর তুলনায় নগণ্য। এই তহবিলের অভাবের কারণে স্টার্টআপগুলো প্রতিযোগিতামূলক বেতন বা সুবিধা দিতে পারে না, ফলে কর্মীরা অন্যত্র চলে যায়।

৩. অবকাঠামোর ঘাটতি: যদিও নিউ টাউন এবং রাজারহাটে আইটি পার্ক এবং স্মার্ট সিটি প্রকল্পগুলো তৈরি হচ্ছে, কলকাতার অবকাঠামো এখনও বেঙ্গালুরুর ইলেকট্রনিক সিটি বা হায়দ্রাবাদের হাইটেক সিটির সঙ্গে তুলনীয় নয়। ট্রাফিক জটিলতা, অপর্যাপ্ত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, এবং শহুরে সুবিধার অভাব তরুণ পেশাদারদের কলকাতায় থাকতে নিরুৎসাহিত করে।

৪. কর্মীদের প্রত্যাশা ও কর্মসংস্কৃতি: আধুনিক কর্মীরা কেবল বেতনই নয়, নমনীয় কাজের সময়, দূরবর্তী কাজের সুযোগ, এবং ক্যারিয়ার উন্নতির সম্ভাবনা চান। কলকাতার বেশিরভাগ স্টার্টআপ এই প্রত্যাশাগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। উদাহরণস্বরূপ, বেঙ্গালুরু বা মুম্বইয়ের স্টার্টআপগুলোতে কর্মীদের জন্য স্টক অপশন, স্বাস্থ্য বীমা, এবং প্রশিক্ষণের সুবিধা বেশি।
৫. অপর্যাপ্ত মেন্টরশিপ ও নেটওয়ার্কিং: কলকাতায় ইনকিউবেটর এবং মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম রয়েছে, যেমন টিআইই কলকাতা, নাসকম স্টার্টআপ ওয়্যারহাউস, এবং আইআইএম কলকাতা ইনোভেশন পার্ক, তবে এগুলো বেঙ্গালুরু বা দিল্লির তুলনায় সীমিত। এই অভাব স্টার্টআপগুলোর বৃদ্ধি এবং কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।

প্রভাব
উচ্চ কর্মী টার্নওভার স্টার্টআপগুলোর জন্য বেশ কয়েকটি সমস্যা সৃষ্টি করে:

  • উৎপাদনশীলতা হ্রাস: নতুন কর্মী নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণের জন্য সময় এবং অর্থ ব্যয় হয়, যা স্টার্টআপের উৎপাদনশীলতা কমায়।
  • জ্ঞানের ক্ষতি: অভিজ্ঞ কর্মীরা চলে গেলে স্টার্টআপগুলো তাদের দক্ষতা এবং প্রকল্প-সম্পর্কিত জ্ঞান হারায়।
  • ব্র্যান্ড ইমেজের ক্ষতি: ঘন ঘন কর্মী পরিবর্তন স্টার্টআপের খ্যাতি এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
  • অর্থনৈতিক প্রভাব: প্রতিভা পলায়নের কারণে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কারণ দক্ষ কর্মীরা অন্য রাজ্যে অবদান রাখছেন।

সমাধানের পথ
পশ্চিমবঙ্গের স্টার্টআপগুলো প্রতিভা ধরে রাখতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিতে পারে:
১. প্রতিযোগিতামূলক বেতন ও সুবিধা: স্টার্টআপগুলোকে প্রতিযোগিতামূলক বেতন, স্বাস্থ্য বীমা, এবং ইক্যুইটি অপশনের মতো সুবিধা প্রদান করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতা ভেঞ্চার্সের মতো ইনকিউবেটরগুলো স্টার্টআপগুলোকে গুগল, অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস, এবং পেটিএমের মতো সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে সুবিধা প্রদান করছে।

Advertisements

২. কর্মসংস্কৃতি উন্নত করা: নমনীয় কাজের সময়, দূরবর্তী কাজের সুযোগ, এবং কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, মেরিটো.এআই এবং পিপল ফার্স্ট কনসালট্যান্টসের মতো সংস্থাগুলো কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং সংস্কৃতি গড়ে তুলতে কাজ করছে।

৩. অবকাঠামো উন্নয়ন: রাজ্য সরকারের উচিত আইটি পার্ক এবং স্মার্ট সিটি প্রকল্পে আরও বিনিয়োগ করা। বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি এবং সেক্টর ভি-এর মতো এলাকায় অবকাঠামো উন্নত করা হচ্ছে, তবে আরও দ্রুত অগ্রগতি প্রয়োজন।

৪. ইনকিউবেশন ও মেন্টরশিপ: নাসকম, টিআইই কলকাতা, এবং আইআইএম কলকাতা ইনোভেশন পার্কের মতো সংস্থাগুলোর মাধ্যমে আরও বেশি মেন্টরশিপ এবং নেটওয়ার্কিং সুযোগ তৈরি করা উচিত। এই প্রোগ্রামগুলো কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে সাহায্য করতে পারে।

৫. সরকারি সহায়তা: স্টার্টআপ বেঙ্গল এবং ওয়েবেলের মতো উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে সরকার তহবিল, ট্যাক্স ছাড়, এবং ইনকিউবেশন সুবিধা বাড়াতে পারে। ২০২৫ সালে কলকাতার স্টার্টআপগুলো প্রথম ত্রৈমাসিকে ২.৬৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে, যা ইতিবাচক লক্ষণ।

সফল স্টার্টআপের উদাহরণ
কলকাতার কিছু স্টার্টআপ, যেমন ওয়াও! মোমো, সাস্তাসুন্দর, এবং স্টকএজ, প্রতিভা ধরে রাখতে এবং বৃদ্ধি অর্জনে সফল হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ওয়াও! মোমো ২০১৯ সালে টাইগার গ্লোবালের কাছ থেকে ২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে এবং ২৮২টিরও বেশি আউটলেট পরিচালনা করছে। এই স্টার্টআপগুলো প্রতিযোগিতামূলক বেতন, ভালো কর্মসংস্কৃতি, এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিভা ধরে রাখছে।

কলকাতার স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম ৫,২০০টিরও বেশি ডিপিআইআইটি-স্বীকৃত স্টার্টআপ নিয়ে দ্রুত বিকাশ লাভ করছে, তবে প্রতিভা ধরে রাখার সমস্যা এর সম্ভাবনাকে সীমিত করছে। প্রতিভা পলায়ন, সীমিত তহবিল, এবং অবকাঠামোর ঘাটতির মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে স্টার্টআপগুলোকে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা, ভালো কর্মসংস্কৃতি, এবং দক্ষতা উন্নয়ন প্রোগ্রামে বিনিয়োগ করতে হবে। একইসঙ্গে, সরকারি উদ্যোগ এবং ইনকিউবেটরগুলোর সমর্থন এই সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যদি এই চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করা যায়, তবে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি শীর্ষস্থানীয় স্টার্টআপ হাব হিসেবে উঠে আসতে পারে।