পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নতুন আইটি নীতি – এটি কি টেক জায়ান্টদের আকর্ষণ করবে?

পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০২৫ সালে একটি নতুন আইটি নীতি (Bengal IT Policy) প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা রাজ্যকে ভারতের পরবর্তী প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে গৃহীত…

West Bengal IT Policy Aims to Attract Tech Giants with Robust Tech Investment Opportunities in WB

পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০২৫ সালে একটি নতুন আইটি নীতি (Bengal IT Policy) প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা রাজ্যকে ভারতের পরবর্তী প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে। এই নীতির মূল উদ্দেশ্য হল গ্লোবাল টেক জায়ান্টদের আকর্ষণ করা এবং আইটি, আইটিইএস (ইনফরমেশন টেকনোলজি এনেবলড সার্ভিসেস), এবং আইসিটি (ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি) খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকার এই নীতির মাধ্যমে রাজ্যের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চায়। নিউ টাউনের বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি টেক হাব এবং আসন্ন বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট (বিজিবিএস) ২০২৫ এই উদ্যোগের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। তবে, এই নীতি কি সত্যিই উইপ্রো, ইনফোসিস, টিসিএস এবং এনটিটি-র মতো টেক জায়ান্টদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে? এই প্রশ্নই এখন রাজ্যের প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

নতুন আইটি নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য
২০২৫ সালের আইটি নীতি সেমিকন্ডাক্টর, গ্লোবাল ক্যাপাবিলিটি সেন্টার (জিসিসি), এবং ড্রোন প্রযুক্তির মতো উদীয়মান ক্ষেত্রগুলিতে বিনিয়োগ আকর্ষণের উপর জোর দিচ্ছে। রাজ্যের তথ্যপ্রযুক্তি ও ইলেকট্রনিক্স মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ো জানিয়েছেন, এই নীতিগুলি বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটের আগে চূড়ান্ত করা হবে, যা ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ অনুষ্ঠিত হবে। এই নীতির খসড়া ইতিমধ্যে প্রস্তুত, এবং সেমিকন্ডাক্টর এবং জিসিসি নীতিগুলি আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংশোধন করা হচ্ছে। এছাড়াও, রাজ্য সরকার ড্রোন নীতি আপডেট করছে, যা ড্রোন প্রযুক্তি-ভিত্তিক স্টার্টআপ এবং উদ্যোক্তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করবে।

   

নীতির মূল লক্ষ্যগুলির মধ্যে রয়েছে:
অবকাঠামো উন্নয়ন: কলকাতার সল্ট লেক সেক্টর ভি এবং নিউ টাউনের মতো আইটি হাবগুলির সম্প্রসারণ, যেখানে বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি টেক হাব ২০২৫ সালে কার্যক্রম শুরু করবে। এই হাবে ৪৫টি কোম্পানির জন্য জমি বরাদ্দ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৯টি কোম্পানি, যেমন রিলায়েন্স, এনটিটি, এবং টিসিএস, ইতিমধ্যে নির্মাণ কাজ শুরু করেছে। এই প্রকল্পটি ২০২৬ সালের মধ্যে ২৫,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং ৪০,০০০ সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা রাখে।

  • উদীয়মান প্রযুক্তি: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি), ব্লকচেইন, এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো প্রযুক্তিতে গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) প্রচার। আইআইটি খড়গপুরের সঙ্গে সহযোগিতায় এই প্রযুক্তিগুলির উপর গবেষণা প্রকল্প চলছে।
  • স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম: ওয়েবেল ইনকিউবেশন সেন্টারের মাধ্যমে স্টার্টআপদের জন্য মেন্টরশিপ, ফান্ডিং, এবং অত্যাধুনিক সুবিধা প্রদান। এই কেন্দ্রটি কলকাতার সল্ট লেকে অবস্থিত এবং উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক মডেল উন্নত করতে সহায়তা করে।
  • ডিজিটাল ইনক্লুসিভিটি: গ্রামীণ এলাকায় ব্রডব্যান্ড এবং আইসিটি সরঞ্জাম সম্প্রসারণ, মহিলাদের জন্য আইটি প্রশিক্ষণ, এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ডিজিটাল অ্যাক্সেসযোগ্যতা বৃদ্ধি।

টেক জায়ান্টদের আকর্ষণে চ্যালেঞ্জ
পশ্চিমবঙ্গের নতুন আইটি নীতি টেক জায়ান্টদের আকর্ষণের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করলেও, বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, রাজ্যের বিনিয়োগ-বান্ধব ইমেজ নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। ২০২৪ সালে অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজ্যে কর্পোরেট রিলোকেশন এবং স্থানীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, টাটা ন্যানো প্রকল্পের সিঙ্গুর বিতর্ক এখনও বিনিয়োগকারীদের মনে সন্দেহ তৈরি করে। তবে, রাজ্য সরকার দাবি করেছে যে, তারা স্বচ্ছ টেন্ডারিং প্রক্রিয়া এবং ব্যবসা করার সুবিধা (ইজ অফ ডুইং বিজনেস) উন্নত করেছে, যা স্কোচ রিপোর্ট ২০২১-এ প্রথম স্থান অর্জন করেছে।

দ্বিতীয়ত, অন্যান্য রাজ্য যেমন কর্ণাটক এবং তামিলনাড়ু ইতিমধ্যে সেমিকন্ডাক্টর এবং আইটি খাতে বিশাল বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে। কর্ণাটক ২০২৪ সালে ৬.২ বিলিয়ন ডলারের প্রযুক্তি বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে, এবং তামিলনাড়ু মাইক্রোসফট, অ্যাপল, এবং গুগলের সঙ্গে বিনিয়োগ চুক্তি করেছে। পশ্চিমবঙ্গকে এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আরও আকর্ষণীয় প্রণোদনা এবং শক্তিশালী অবকাঠামো প্রয়োজন।

অর্থনৈতিক প্রভাব এবং সম্ভাবনা
পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১০.৫% হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা জাতীয় গড় ৭.৩২%-এর তুলনায় বেশি। রাজ্যের মোট রাজ্য গার্হস্থ্য পণ্য (জিএসডিপি) ২০২৫-২৬ সালে ২০.৩ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। আইটি খাতে বিনিয়োগ এই প্রবৃদ্ধিকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে। বর্তমানে, রাজ্যে ১,৫০০-এর বেশি আইটি কোম্পানি কাজ করছে, যারা ১,২০,০০০-এর বেশি পেশাদার নিয়োগ করেছে। বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি টেক হাব সম্পূর্ণরূপে চালু হলে, এটি ১ লক্ষ সরাসরি এবং ৫০,০০০ পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, যা রিয়েল এস্টেট, হসপিটালিটি, এবং ভোক্তা বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

Advertisements

ওয়েবেল (West Bengal Electronics Industry Development Corporation), রাজ্যের আইটি এবং ইলেকট্রনিক্স খাতের নোডাল এজেন্সি, এই নীতি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ওয়েবেল ইতিমধ্যে সল্ট লেক এবং নিউ টাউনে আইটি পার্ক এবং ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করেছে, এবং আইআইটি খড়গপুরের সঙ্গে সহযোগিতায় এআই এবং আইওটি-র মতো প্রযুক্তিতে গবেষণা প্রকল্প চালাচ্ছে। এছাড়াও, রাজ্য সরকার জাপান, জার্মানি, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে।

রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
নতুন আইটি নীতি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ সাগরিকা ঘোষ রাজ্যকে ভারতের “নতুন আইটি রাজধানী” হিসেবে বর্ণনা করেছেন, এবং বিজিবিএস ২০২৫-কে রাজ্যের বিনিয়োগ সম্ভাবনা প্রদর্শনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে, বিরোধী দলগুলি, যেমন সিপিআই(এম) এবং বিজেপি, সরকারের বিনিয়োগ-বান্ধব নীতির সমালোচনা করেছে, দাবি করে যে স্থানীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং আমলাতান্ত্রিক বাধা বিনিয়োগকারীদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

সামাজিকভাবে, এই নীতি গ্রামীণ এলাকায় ডিজিটাল সংযোগ সম্প্রসারণ এবং মহিলাদের জন্য আইটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ডিজিটাল ইনক্লুসিভিটি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই উদ্যোগগুলি রাজ্যের যুবকদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে সহায়তা করবে।

পশ্চিমবঙ্গের ২০২৫ সালের আইটি নীতি রাজ্যকে ভারতের প্রযুক্তি মানচিত্রে একটি শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সম্ভাবনা রাখে। বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি টেক হাব, সেমিকন্ডাক্টর এবং জিসিসি নীতি, এবং স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের উন্নয়ন টেক জায়ান্টদের আকর্ষণ করার জন্য শক্তিশালী পদক্ষেপ। তবে, স্থানীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং প্রতিযোগিতামূলক রাজ্যগুলির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। বিজিবিএস ২০২৫-এর মাধ্যমে রাজ্য সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ এবং বিনিয়োগকারীদের প্রতিক্রিয়া এই নীতির সাফল্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।