ভারতের স্টার্টআপ (Indian Startups) ইকোসিস্টেম, যা একসময় বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল প্রযুক্তি কেন্দ্রগুলির মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত হত, বর্তমানে একটি গুরুতর আর্থিক সংকটের মুখোমুখি। ২০২৫ সালে, অনেক ভারতীয় স্টার্টআপ (Indian Startups)উচ্চ বার্ন রেট (নগদ অর্থ ব্যয়ের হার) এবং সীমিত ফান্ডিংয়ের কারণে নগদ অর্থের সংকটে পড়ছে। এই সংকটের পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি কারণ, যার মধ্যে রয়েছে আক্রমণাত্মক সম্প্রসারণ, অতিরিক্ত ব্যয়, বাজারে প্রতিযোগিতা এবং বিনিয়োগকারীদের ক্রমবর্ধমান সতর্কতা। এই প্রতিবেদনে আমরা ভারতীয় স্টার্টআপগুলির এই বার্ন রেট সংকটের কারণ, প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।
Indian Startups: বার্ন রেট কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
বার্ন রেট হল সেই হার যা দিয়ে একটি স্টার্টআপ (Indian Startups)তার নগদ মজুদ ব্যয় করে, যতক্ষণ না এটি লাভজনক হয় বা ইতিবাচক নগদ প্রবাহ অর্জন করে। এটি দুটি ধরনের হতে পারে: গ্রস বার্ন রেট (মোট মাসিক ব্যয়) এবং নেট বার্ন রেট (আয় বিয়োগ করে মাসিক ব্যয়)। স্টার্টআপগুলির (Indian Startups)জন্য বার্ন রেট একটি গুরুত্বপূর্ণ মেট্রিক, কারণ এটি নির্ধারণ করে যে তাদের কত মাসের “রানওয়ে” (অর্থাৎ নগদ মজুদ শেষ হওয়ার আগে কত সময় তারা চলতে পারে) রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি স্টার্টআপের ১০ কোটি টাকার নগদ মজুদ থাকে এবং এটি প্রতি মাসে ১ কোটি টাকা ব্যয় করে, তবে তার রানওয়ে ১০ মাস।

ভারতীয় স্টার্টআপগুলির বার্ন রেট সংকটের কারণ
১. আক্রমণাত্মক সম্প্রসারণ: অনেক ভারতীয় স্টার্টআপ (Indian Startups), যেমন ফ্লিপকার্ট, ওলা এবং জোমাটো, বাজারে দ্রুত প্রভাব বিস্তারের জন্য আক্রমণাত্মক সম্প্রসারণ কৌশল গ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে শেষ হওয়া বছরে ফ্লিপকার্টের বার্ন রেট ছিল ৩.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ভারতের যে কোনও কোম্পানির মধ্যে সর্বোচ্চ। এই উচ্চ বার্ন রেটের পেছনে ছিল তাদের বিস্তৃত সম্প্রসারণ পরিকল্পনা, যেমন ইনস্টাকার্ট এবং মিন্ট্রায় বিনিয়োগ।
২. উচ্চ বিপণন ও কর্মচারী ব্যয়: স্টার্টআপগুলি প্রায়ই বাজারে দখল এবং গ্রাহক আকর্ষণের জন্য বিপণন, প্রচার এবং উচ্চ বেতনের কর্মচারী নিয়োগে বড় অংকের বিনিয়োগ করে। জোমাটোর মতো কোম্পানিগুলির ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিজ্ঞাপন ও প্রচার ব্যয় ১২.১৭ বিলিয়ন রুপি থেকে বেড়ে ১২.২৭ বিলিয়ন রুপি হয়েছে।

৩. ফান্ডিংয়ের অভাব: ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে ভারতীয় স্টার্টআপগুলি ফান্ডিংয়ের তীব্র সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। রয়টার্সের মতে, বিনিয়োগকারীরা এখন সতর্ক হয়ে গেছে এবং ছোট পরিমাণে ফান্ডিং প্রদান করছে। উদাহরণস্বরূপ, ওলার মূল্যায়ন ২০২১ সাল থেকে ৭৪% কমে ১.৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
৪. ভুল বাজার মূল্যায়ন: অনেক স্টার্টআপ ভুলভাবে ভারতের ভোক্তা বাজারের চাহিদা মূল্যায়ন করেছে। ব্লুম ভেঞ্চার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীর্ষ ৩০ মিলিয়ন পরিবারের বাইরে ভোক্তা ব্যয় তীব্রভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা স্টার্টআপগুলির আয়ের উপর প্রভাব ফেলেছে।
প্রভাব এবং চ্যালেঞ্জ
উচ্চ বার্ন রেটের ফলে স্টার্টআপগুলি দ্রুত নগদ মজুদ শেষ করে ফেলছে, যার ফলে অনেক কোম্পানি ছাঁটাই, কার্যক্রম স্কেল-ডাউন বা এমনকি বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখোমুখি হচ্ছে। ২০২৩ সালে, ইনক৪২-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৫টি ভারতীয় স্টার্টআপ তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে, যার মধ্যে টিকি এবং আনারের মতো কোম্পানি অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও, পেটিএম এবং বাইজুসের মতো বড় নামগুলি মূল্যায়ন হ্রাস এবং আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।
এই সংকটের ফলে স্টার্টআপগুলির জন্য নতুন ফান্ডিং সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিনিয়োগকারীরা এখন লাভজনকতার উপর বেশি জোর দিচ্ছেন এবং ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ের দিকে ঝুঁকছেন। এই পরিস্থিতি ভারতের অর্থনীতির উপরও প্রভাব ফেলছে, কারণ স্টার্টআপগুলি গত আট বছরে ২০-২৫% নতুন চাকরি এবং ১০-১৫% অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দায়ী।
সমাধানের পথ
১. ব্যয় হ্রাস: স্টার্টআপগুলিকে অ-অপরিহার্য ব্যয়, যেমন অফিস স্থান, বিলাসবহুল সুবিধা এবং অতিরিক্ত বিপণন ব্যয় কমাতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, সুগারসিআরএম-এর সিইও অগাস্টিন ২৪ মিলিয়ন ডলারের মাসিক বার্ন রেটকে ৭ মিলিয়ন ডলারের ইতিবাচক নগদ প্রবাহে রূপান্তরিত করেছিলেন ছাঁটাই এবং বিপণন ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে।
২. আয় বৃদ্ধি: ব্যয় কমানোর পাশাপাশি, স্টার্টআপগুলিকে আয়ের নতুন উৎস সন্ধান করতে হবে। জোমাটোর হাইপারপিউর এবং ব্লিঙ্কিটের মতো ব্যবসায়িক উল্লম্বগুলি আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।
৩. ফান্ডিংয়ের বিকল্প উৎস: স্টার্টআপগুলি সরকারি অনুদান, ফিলানথ্রপিক প্রকল্প এবং নন-ডিলিউটিভ ফান্ডিংয়ের দিকে মনোযোগ দিতে পারে।
৪. আর্থিক শৃঙ্খলা: নিয়মিত আর্থিক নিরীক্ষণ এবং বাজেট পর্যালোচনা স্টার্টআপগুলিকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় চিহ্নিত করতে এবং বার্ন রেট নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে।
ভারতীয় স্টার্টআপগুলির বার্ন রেট সংকট তাদের দ্রুত প্রবৃদ্ধির কৌশল এবং বিনিয়োগকারীদের অতিরিক্ত প্রত্যাশার ফল। ফ্লিপকার্ট, ওলা এবং জোমাটোর মতো কোম্পানিগুলি উচ্চ বার্ন রেটের মাধ্যমে বাজারে দখল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ফান্ডিংয়ের সংকট এবং ভুল বাজার মূল্যায়ন তাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। স্টার্টআপগুলিকে এখন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, আয় বৃদ্ধি এবং আর্থিক শৃঙ্খলার মাধ্যমে তাদের রানওয়ে প্রসারিত করতে হবে। সরকার এবং বিনিয়োগকারীদের সমর্থনে, ভারতীয় স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে।