কলকাতার ‘সিলিকন ভ্যালি’ হিসেবে পরিচিত সল্টলেক সেক্টর ফাইভ, যা একসময় আইটি এবং বিপিও (বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং) শিল্পের জন্য পূর্ব ভারতের একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল, সেখানে এখন কল সেন্টার (Call Centers) বন্ধের গুঞ্জন এবং চাকরি হারানোর উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। এই অঞ্চলের অসংখ্য যুবক-যুবতীদের জন্য কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হিসেবে পরিচিত সেক্টর ফাইভে বেশ কয়েকটি কল সেন্টারের কার্যক্রম হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কর্মী ছাঁটাইয়ের খবরে স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। এই প্রতিবেদনে আমরা সেক্টর ফাইভের বর্তমান পরিস্থিতি এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি।
সল্টলেক সেক্টর ফাইভের আইটি-বিপিও শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৯ সালে, যখন ওয়েবেল (ওয়েস্ট বেঙ্গল ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন) সল্টলেক ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স (SALTLEC) প্রতিষ্ঠা করে। প্রাথমিকভাবে ইলেকট্রনিক্স শিল্পের জন্য পরিকল্পিত এই এলাকা পরবর্তীতে কলকাতা বিমানবন্দরের নৈকট্য এবং সাশ্রয়ী জনশক্তির কারণে আইটি-বিপিও হাবে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে এই অঞ্চলে প্রায় ১৪.৬ মিলিয়ন বর্গফুট গ্রেড-এ অফিস স্পেস রয়েছে, যার বেশিরভাগই আইটি এবং বিপিও কোম্পানিগুলোর দখলে। এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে গ্লোবিভা, ডিজিটেক কল সিস্টেম, উইপ্রো, এবং বাজাজ ফাইন্যান্সের মতো নামকরা প্রতিষ্ঠান। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবৈধ কল সেন্টারের কার্যক্রম এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে এই শিল্পের উপর ছায়া ফেলেছে।
গত কয়েক বছরে, সেক্টর ফাইভে একাধিক অবৈধ কল সেন্টারের কার্যক্রম ধরা পড়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বিধাননগর পুলিশ সেক্টর ফাইভের গ্লোবসিন ক্রিস্টাল টাওয়ারে একটি ফেক কল সেন্টারে অভিযান চালিয়ে ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে। এই কল সেন্টারটি মার্কিন নাগরিকদের প্রতারণা করে টেকনিক্যাল সাপোর্টের নামে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিল। ২০২৫ সালের মার্চ মাসে বেঙ্গল সাইবার সেল এবং বিধাননগর পুলিশ সেক্টর ফাইভের ইমাজিন টেক পার্কে আরেকটি অবৈধ কল সেন্টারে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে এবং ২০৪ কোটি টাকার বিটকয়েন লেনদেনের তথ্য উদ্ধার করে। এই ধরনের ঘটনাগুলো সেক্টর ফাইভের বিপিও শিল্পের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যার ফলে বৈধ কল সেন্টারগুলোর উপরও নজরদারি বেড়েছে।
এই অবৈধ কার্যক্রম ছাড়াও, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং আউটসোর্সিং শিল্পে প্রতিযোগিতার কারণে কিছু বিপিও সংস্থা তাদের কার্যক্রম কমিয়ে ফেলছে বা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিচ্ছে। সেক্টর ফাইভে কর্মরত একাধিক কর্মী জানিয়েছেন, তাঁদের কোম্পানিগুলো ক্লায়েন্টের অভাব এবং ব্যয় হ্রাসের জন্য কর্মী ছাঁটাই করছে। “আমার কোম্পানিতে গত ছয় মাসে প্রায় ৩০ শতাংশ কর্মী কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা শুনছি কোম্পানিটি শীঘ্রই এই অফিস বন্ধ করতে পারে,” বলছেন সেক্টর ফাইভের একটি বিপিও-তে কর্মরত রাহুল মণ্ডল (ছদ্মনাম)। এই ধরনের খবরে স্থানীয় যুবক-যুবতীদের মধ্যে চাকরি হারানোর ভয় ছড়িয়ে পড়ছে।
তবে, সেক্টর ফাইভের সব কল সেন্টার বন্ধ হচ্ছে না। জবহাই.কম-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সেক্টর ফাইভে ৪২০টিরও বেশি কাস্টমার সাপোর্ট এবং টেলিকলার জব ওপেনিং রয়েছে, যার মধ্যে গ্লোবিভা, ডিজিটেক কল সিস্টেম এবং উইপ্রোর মতো কোম্পানিগুলো নিয়োগ চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া, ভি৩ আউটসোর্সিং সলিউশনসের মতো কোম্পানিগুলো নন-প্রফিট সংস্থাগুলোর জন্যও পরিষেবা প্রদান শুরু করেছে, যা বিপিও শিল্পের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। তবুও, অবৈধ কল সেন্টারের কারণে শিল্পের সুনাম ক্ষুণ্ণ হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে, যা দীর্ঘমেয়াদে এই অঞ্চলের অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
সেক্টর ফাইভের কল সেন্টার শিল্পের এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেও কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। নবদিগন্ত ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনশিপ অথরিটি (এনডিআইটিএ)-এর এক কর্তা বলেছেন, “সেক্টর ফাইভ উদ্ভাবন, স্টার্টআপ এবং দক্ষ জনশক্তির একটি প্রাণবন্ত কেন্দ্র। এর কৌশলগত অবস্থান এবং সম্প্রসারিত অবকাঠামোর কারণে এটি ক্রমাগত সমৃদ্ধ হচ্ছে।” তিনি আরও জানান, সেক্টর ফাইভে নতুন আইটি পার্ক এবং বাণিজ্যিক প্রকল্পের কাজ চলছে, যা ভবিষ্যতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কর্মীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। সেক্টর ফাইভে প্রায় এক লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল। যদি বড় আকারে কল সেন্টার বন্ধ হয়, তবে এটি স্থানীয় অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলবে। স্থানীয় একজন বাসিন্দা, রিয়া সেন (ছদ্মনাম), বলেন, “আমার ভাই এখানে একটি কল সেন্টারে কাজ করে। গত মাসে তাঁর কোম্পানি ৫০ জন কর্মীকে ছাঁটাই করেছে। আমরা এখন খুবই চিন্তিত।”
সেক্টর ফাইভের এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার এবং শিল্প সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। অবৈধ কল সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি বৈধ বিপিও কোম্পানিগুলোর জন্য আরও বিনিয়োগ আকর্ষণ করা জরুরি। এছাড়া, কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করাও গুরুত্বপূর্ণ। সেক্টর ফাইভের কল সেন্টার শিল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হলেও, সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এই অঞ্চল তার ‘সিলিকন ভ্যালি অফ দি ইস্ট’ খ্যাতি ধরে রাখতে পারে।