নিজস্ব সংবাদদাতা, কলকাতা, ২৮ জুলাই ২০২৫: ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) শিল্পের ক্ষেত্রে কলকাতা দীর্ঘদিন ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হায়দ্রাবাদের মতো শহরগুলো দ্রুত আইটি হাব হিসেবে উঠে আসছে, যা কলকাতার টেক প্রতিভাদের (Kolkata Tech Talent) আকর্ষণ করছে। সাম্প্রতিক প্রবণতা এবং শিল্প বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কলকাতার অনেক তরুণ প্রযুক্তি পেশাদার হায়দ্রাবাদে স্থানান্তরিত হচ্ছেন, যেখানে বেতন, কর্মসংস্কৃতি এবং ক্যারিয়ারের বৃদ্ধির সুযোগ বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। এই প্রতিবেদনে আমরা কলকাতা এবং হায়দ্রাবাদের আইটি শিল্পের বেতন, সংস্কৃতি এবং বৃদ্ধির তুলনা করব এবং কেন কলকাতার প্রতিভারা হায়দ্রাবাদের দিকে ঝুঁকছে, তা বিশ্লেষণ করব।
কলকাতার আইটি শিল্প: বর্তমান অবস্থা
কলকাতা তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং কম জীবনযাত্রার ব্যয়ের জন্য বিখ্যাত। তবে, আইটি শিল্পের ক্ষেত্রে শহরটি বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ এবং পুনে-র মতো শহরগুলোর তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। কলকাতায় বেশ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি (যেমন, TCS, Infosys, Cognizant) এবং স্থানীয় আইটি ফার্মের উপস্থিতি থাকলেও, প্রকল্পের সংখ্যা এবং উচ্চ বেতনের সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম। একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, কলকাতায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের গড় বার্ষিক বেতন ৫.৯ লক্ষ টাকা, যা ভারতের অন্যান্য বড় আইটি হাবের তুলনায় অনেক কম।
কলকাতার আইটি শিল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো উচ্চ-মানের প্রকল্পের অভাব এবং নতুন প্রযুক্তি (যেমন, AI, ক্লাউড কম্পিউটিং, সাইবারসিকিউরিটি) নিয়ে কাজের সুযোগের সীমাবদ্ধতা। অনেক তরুণ পেশাদার মনে করেন যে, কলকাতায় থাকলে তাঁদের ক্যারিয়ারের বৃদ্ধি সীমিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একজন অভিজ্ঞ আইটি পেশাদার, যিনি কলকাতায় তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, বলেছেন, “কলকাতায় ছয় বছর কাটানো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। বেঙ্গালুরুতে গিয়ে আমি ১০ বছরের অভিজ্ঞতায় ৪৫ লক্ষ টাকার বেতন পাচ্ছি। কলকাতায় এমন সুযোগ পাওয়া প্রায় অসম্ভব।”
হায়দ্রাবাদ: নতুন আইটি হাব
হায়দ্রাবাদ, যিনি ‘সাইবারাবাদ’ নামে পরিচিত, গত দুই দশকে ভারতের আইটি শিল্পে একটি শক্তিশালী কেন্দ্র হিসেবে উঠে এসেছে। গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন এবং ফেসবুকের মতো বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি জায়ান্টরা হায়দ্রাবাদে তাদের বড় বড় অফিস স্থাপন করেছে। শহরটির আইটি রপ্তানি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১.০৯ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা জাতীয় গড় বৃদ্ধির হারের তুলনায় দ্বিগুণ। হায়দ্রাবাদের হাইটেক সিটি এবং গাছিবাউলি এলাকায় আধুনিক অফিস, উন্নত মেট্রো সংযোগ এবং ভালো রাস্তার অবকাঠামো রয়েছে, যা এটিকে প্রযুক্তি পেশাদারদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
হায়দ্রাবাদে আইটি পেশাদারদের বেতন কলকাতার তুলনায় অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ডেটা সায়েন্স পেশাদারদের গড় বেতন ১৬.১ লক্ষ টাকা এবং প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট পেশাদারদের জন্য ২১.১ লক্ষ টাকা। এছাড়া, হায়দ্রাবাদে গ্লোবাল ক্যাপাবিলিটি সেন্টার (GCC) স্থাপনের জন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ বাড়ছে, যা AI, সাইবারসিকিউরিটি এবং ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মতো উচ্চ-দক্ষতার ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ তৈরি করছে।
বেতনের তুলনা
কলকাতার তুলনায় হায়দ্রাবাদে আইটি পেশাদারদের বেতন ১৫-২৫% বেশি। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতায় একজন ফ্রেশার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের গড় বেতন ৩.৩৯ লক্ষ টাকা, যেখানে হায়দ্রাবাদে এটি ৪.০৭ থেকে ৭.৪৯ লক্ষ টাকার মধ্যে। অভিজ্ঞ পেশাদারদের ক্ষেত্রে, হায়দ্রাবাদে ১৪ বছরের অভিজ্ঞতার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বেতন পেতে পারেন। কলকাতায় এমন উচ্চ বেতনের সুযোগ খুবই সীমিত।
কর্মসংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার মান
কলকাতার জীবনযাত্রার ব্যয় হায়দ্রাবাদের তুলনায় কম। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতায় একটি দুই বেডরুমের ফ্ল্যাটের ভাড়া বছরে প্রায় ২ লক্ষ টাকা, যেখানে হায়দ্রাবাদে এটি ৩-৪ লক্ষ টাকা হতে পারে। তবে, হায়দ্রাবাদের উন্নত অবকাঠামো, যেমন মেট্রো সংযোগ এবং ভালো রাস্তা, যাতায়াতকে আরও সুবিধাজনক করে। হায়দ্রাবাদের কর্মসংস্কৃতি আধুনিক এবং গ্লোবাল, যেখানে বৈচিত্র্যময় দল এবং উদ্ভাবনী প্রকল্পের উপর জোর দেওয়া হয়। কলকাতায় কর্মসংস্কৃতি তুলনামূলকভাবে ঐতিহ্যবাহী, এবং অনেক কোম্পানির প্রকল্প বেঙ্গালুরু বা হায়দ্রাবাদ থেকে পরিচালিত হয়।
হায়দ্রাবাদের জীবনযাত্রার মানও উচ্চ। শহরটি মার্সারের কোয়ালিটি অফ লিভিং সার্ভেতে ভারতের শীর্ষ শহর হিসেবে সাতবার স্থান পেয়েছে। এটি সাশ্রয়ী জীবনযাত্রা, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এবং কম ট্রাফিকের জন্য পরিচিত। কলকাতা, তার সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি এবং নস্টালজিয়া সত্ত্বেও, ট্রাফিক এবং অবকাঠামোর সমস্যার কারণে পিছিয়ে রয়েছে।
কেন হায়দ্রাবাদের দিকে ঝুঁকছে কলকাতার প্রতিভা?
১. উচ্চ বেতন এবং ক্যারিয়ারের সুযোগ: হায়দ্রাবাদে উচ্চ-মানের প্রকল্প এবং বেতন কলকাতার তুলনায় অনেক বেশি। প্রোডাক্ট-ভিত্তিক কোম্পানি এবং স্টার্টআপগুলোর উপস্থিতি তরুণ পেশাদারদের আকর্ষণ করে।
২. উন্নত অবকাঠামো: হায়দ্রাবাদের মেট্রো এবং ভালো রাস্তার অবকাঠামো যাতায়াতকে সহজ করে।
৩. গ্লোবাল কানেক্টিভিটি: হায়দ্রাবাদে গ্লোবাল কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি এবং GCC-এর বৃদ্ধি তরুণদের বিশ্বমানের প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ দেয়।
৪. জীবনযাত্রার ভারসাম্য: Facets: জীবনযাত্রার ভারসাম্য: হায়দ্রাবাদে কম জীবনযাত্রার ব্যয় এবং ভালো অবকাঠামোর কারণে পেশাদাররা ভালো জীবনযাত্রার ভারসাম্য পান।
সমাজের প্রতিক্রিয়া
কলকাতার অনেক তরুণ পেশাদার হায়দ্রাবাদে স্থানান্তরিত হওয়ার বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। কেউ কেউ মনে করেন, কলকাতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং কম খরচের জীবনযাত্রা শহরটিকে বাসযোগ্য করে, তবে ক্যারিয়ারের সুযোগের অভাব তাঁদের অন্যত্র যেতে বাধ্য করে। এক্স-এর একটি পোস্টে একজন ব্যবহারকারী বলেছেন, “কলকাতায় থাকলে নস্টালজিয়া থাকে, কিন্তু ক্যারিয়ারের জন্য হায়দ্রাবাদ বা বেঙ্গালুরুতে যাওয়া বাধ্যতামূলক।”
কলকাতার টেক প্রতিভারা হায়দ্রাবাদের দিকে ঝুঁকছে উচ্চ বেতন, উন্নত অবকাঠামো এবং গ্লোবাল প্রকল্পে কাজের সুযোগের জন্য। যদিও কলকাতার জীবনযাত্রার ব্যয় কম এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ, তবে আইটি শিল্পে এর সীমিত সুযোগ তরুণদের হায়দ্রাবাদের মতো শহরে স্থানান্তরিত হতে উৎসাহিত করছে। হায়দ্রাবাদের আধুনিক কর্মসংস্কৃতি, উচ্চ বেতন এবং জীবনযাত্রার ভারসাম্য এটিকে ২০২৫ সালে আইটি পেশাদারদের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য করে তুলেছে। তবে, কলকাতার আইটি শিল্পের বৃদ্ধির জন্য সরকারি এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজন, যাতে শহরটি তার প্রতিভা ধরে রাখতে পারে।