পশ্চিমবঙ্গ ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) শিল্পে একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়, বিশেষ করে কলকাতার সল্টলেক সেক্টর ফাইভ, রাজারহাট এবং নিউ টাউনের মতো এলাকায়। এই অঞ্চলে টিসিএস, উইপ্রো, ক্যাপজেমিনি, এবং ইনফোসিসের মতো বড় বহুজাতিক কোম্পানি থেকে শুরু করে ছোট ও মাঝারি স্টার্টআপগুলি কাজ করছে। তবে, পশ্চিমবঙ্গের আইটি শিল্প একটি গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে—প্রতিভার বহির্গমন বা ‘ব্রেন ড্রেন’ (IT Talent Drain)। অনেক দক্ষ আইটি পেশাদার বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ, পুনে বা বিদেশের মতো উন্নত বাজারের দিকে চলে যাচ্ছেন। এই নিবন্ধে আমরা পশ্চিমবঙ্গে আইটি প্রতিভার বহির্গমনের কারণ, এর প্রভাব এবং এই প্রবণতা উল্টে দেওয়ার জন্য সম্ভাব্য সমাধানগুলি নিয়ে আলোচনা করব।
প্রতিভার বহির্গমনের কারণ
পশ্চিমবঙ্গ থেকে আইটি প্রতিভার বহির্গমনের পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে, যা স্থানীয় এবং বৈশ্বিক উভয় স্তরে প্রভাব ফেলে:
সীমিত উচ্চ-মানের চাকরির সুযোগ: যদিও কলকাতায় বেশ কিছু বড় আইটি কোম্পানি রয়েছে, তবে বেঙ্গালুরু বা হায়দ্রাবাদের তুলনায় উচ্চ-মানের প্রকল্প বা গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) কেন্দ্রের সংখ্যা কম। অনেক আইটি পেশাদার উচ্চতর দায়িত্ব বা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে কাজ করার সুযোগের জন্য অন্য শহরে চলে যান। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের একটি রিপোর্টে দেখা গেছে যে ভারতের আইটি শিল্পে প্রায় ২০ লক্ষ পেশাদার বিদেশে চলে গেছেন, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে।
বেতনের বৈষম্য: কলকাতায় আইটি পেশাদারদের বেতন অন্যান্য প্রধান আইটি হাবের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম। উদাহরণস্বরূপ, একজন মধ্য-স্তরের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কলকাতায় যেখানে বছরে ৮-১২ লক্ষ টাকা উপার্জন করেন, সেখানে বেঙ্গালুরুতে একই ভূমিকায় ১৫-২০ লক্ষ টাকা পেতে পারেন। এই বেতনের বৈষম্য অনেককে অন্যত্র সুযোগ খুঁজতে প্ররোচিত করে।
শিক্ষা ও গবেষণার সীমাবদ্ধতা: পশ্চিমবঙ্গে আইআইটি খড়গপুরের মতো শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান থাকলেও, সামগ্রিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা এবং গবেষণার সুযোগ বৈশ্বিক মানের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। অনেক ছাত্র বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাড়ি দেন, এবং তাদের মধ্যে ৮৫% ফিরে আসেন না। এছাড়াও, স্থানীয় কলেজগুলিতে উদ্ভাবনী কোর্স বা শিল্প-ভিত্তিক প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে।
জীবনযাত্রার মান: কলকাতার জীবনযাত্রার খরচ তুলনামূলকভাবে কম হলেও, শহরটি দূষণ, ট্রাফিক জটিলতা এবং অবকাঠামোগত সমস্যার মতো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই কারণে অনেক পেশাদার উন্নত জীবনযাত্রার জন্য বিদেশ বা অন্যান্য ভারতীয় শহরে চলে যান।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চাপ: ভারতীয় সমাজে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, তরুণ প্রজন্মের উপর উচ্চ বেতনের চাকরি বা বিদেশে কাজ করার জন্য সামাজিক চাপ রয়েছে। এই চাপ অনেককে বিদেশে বা অন্য শহরে সুযোগ খুঁজতে বাধ্য করে।
প্রতিভার বহির্গমনের প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গে আইটি প্রতিভার বহির্গমন রাজ্যের অর্থনীতি এবং সমাজের উপর গভীর প্রভাব ফেলছে:
- দক্ষ শ্রমশক্তির ঘাটতি: প্রতিভার বহির্গমনের ফলে পশ্চিমবঙ্গে দক্ষ আইটি পেশাদারদের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এটি স্থানীয় কোম্পানিগুলির উদ্ভাবন এবং প্রতিযোগিতার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। TeamLease Services-এর মতে, ভারতে ১৫০ মিলিয়ন দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে, এবং পশ্চিমবঙ্গও এর ব্যতিক্রম নয়।
- অর্থনৈতিক ক্ষতি: প্রতিভার বহির্গমনের ফলে ভারত বছরে ৩৫-৫০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, এবং পশ্চিমবঙ্গ এই ক্ষতির একটি অংশ বহন করে। স্থানীয়ভাবে শিক্ষিত পেশাদাররা বিদেশে বা অন্য শহরে চলে গেলে রাজ্যের শিক্ষা বিনিয়োগের প্রতিফল হ্রাস পায়।
- গবেষণা ও উদ্ভাবনের স্থবিরতা: পশ্চিমবঙ্গে গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) কার্যক্রম সীমিত। India Innovation Index 2021 অনুসারে, ভারতের গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে মোট জিডিপির মাত্র ০.৭% ব্যয় হয়, যা বৈশ্বিক মানের তুলনায় অনেক কম। এটি প্রতিভাবান পেশাদারদের স্থানীয়ভাবে থাকার উৎসাহ হ্রাস করে।
- সামাজিক প্রভাব: গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গ থেকে ছাত্র ও পেশাদারদের বহির্গমন স্থানীয় সম্প্রদায়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। IJIREM-এর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রামীণ এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরুণ প্রজন্মের উপর নির্ভরশীল, এবং তাদের চলে যাওয়া স্থানীয় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে।
সমাধানের উপায়
পশ্চিমবঙ্গে আইটি প্রতিভার বহির্গমন রোধ করতে এবং প্রতিভা ফিরিয়ে আনতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
আইটি অবকাঠামোর উন্নয়ন: পশ্চিমবঙ্গ সরকার বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি টেক হাবের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে আইটি অবকাঠামো উন্নত করছে। এই প্রকল্পটি ২০২৫ সালে চালু হওয়ার কথা রয়েছে এবং এটি ৪০,০০০ সরাসরি এবং ৫০,০০০ পরো ক্ষ চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ধরনের উদ্যোগ আরও বাড়ানো প্রয়োজন।
গবেষণা ও উন্নয়ন বিনিয়োগ: রাজ্য সরকার এবং বেসরকারি খাতকে গবেষণা ও উন্নয়নে আরও বিনিয়োগ করতে হবে। উন্নত ল্যাব, কম্পিউটেশনাল সুবিধা এবং শিল্প-অ্যাকাডেমিয়া সহযোগিতা প্রতিভা ধরে রাখতে সাহায্য করবে।
প্রতিযোগিতামূলক বেতন ও সুবিধা: আইটি কোম্পানিগুলিকে প্রতিযোগিতামূলক বেতন এবং সুবিধা প্রদান করতে হবে। এছাড়াও, কর্মক্ষেত্রে সংস্কৃতি এবং কাজ-জীবনের ভারসাম্য উন্নত করা প্রয়োজন।
শিক্ষার মান উন্নয়ন: স্থানীয় কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন এবং ডেটা সায়েন্সের মতো আধুনিক কোর্স চালু করা উচিত। এটি ছাত্রদের স্থানীয়ভাবে থাকার জন্য উৎসাহিত করবে।
রিভার্স ব্রেন ড্রেন প্রচার: প্রবাসী ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনার জন্য নীতি তৈরি করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, জোহো কর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীধর ভেম্বু প্রবাসী প্রতিভাকে গ্রামীণ ভারতে ফিরিয়ে এনে উদ্যোক্তা মনোভাব জাগিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গেও এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গে আইটি প্রতিভার বহির্গমন একটি জটিল সমস্যা, যা সীমিত চাকরির সুযোগ, বেতনের বৈষম্য, শিক্ষার সীমাবদ্ধতা এবং জীবনযাত্রার মানের মতো কারণে উদ্ভূত। এই বহির্গমন রাজ্যের অর্থনীতি, গবেষণা এবং সামাজিক উন্নয়নের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তবে, বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি টেক হাবের মতো উদ্যোগ, গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ, এবং শিক্ষার মান উন্নয়নের মাধ্যমে এই প্রবণতা উল্টানো সম্ভব। রাজ্য সরকার, বেসরকারি খাত এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সমন্বিত প্রচেষ্টা পশ্চিমবঙ্গকে আইটি শিল্পে একটি শক্তিশালী কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এবং প্রতিভা ধরে রাখতে সাহায্য করবে।