কলকাতার আইটি কোম্পানিগুলোর কাজের পরিবেশ কি বিষাক্ত নাকি সহায়ক? কর্মীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা

কলকাতা (Kolkata ) ভারতের পূর্বাঞ্চলের আইটি হাব হিসেবে পরিচিত, যেখানে টিসিএস, উইপ্রো, ইনফোসিস, আইবিএম, এবং ডেলয়েটের মতো বড় আইটি কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি অসংখ্য স্টার্টআপ এবং মাঝারি…

Is Kolkata IT Work Culture Toxic or Supportive

কলকাতা (Kolkata ) ভারতের পূর্বাঞ্চলের আইটি হাব হিসেবে পরিচিত, যেখানে টিসিএস, উইপ্রো, ইনফোসিস, আইবিএম, এবং ডেলয়েটের মতো বড় আইটি কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি অসংখ্য স্টার্টআপ এবং মাঝারি আকারের সংস্থা কাজ করছে। তবে, কলকাতার আইটি কোম্পানিগুলোর কাজের পরিবেশ নিয়ে মিশ্র ধারণা রয়েছে। কেউ কেউ এটিকে সহায়ক এবং সহযোগিতামূলক বলে মনে করেন, আবার কেউ কেউ এর বিষাক্ততা এবং কাজ-জীবনের ভারসাম্যহীনতার কথা উল্লেখ করেন। এই নিবন্ধে আমরা কর্মীদের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কলকাতার আইটি কাজের পরিবেশের একটি সুষম চিত্র তুলে ধরব।

কলকাতার আইটি কাজের পরিবেশ: সহায়ক দিকগুলো
কলকাতার আইটি সেক্টর গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে সল্টলেক সেক্টর V এবং নিউ টাউনের মতো এলাকায়। বেশ কিছু কোম্পানি তাদের সহায়ক কাজের পরিবেশের জন্য প্রশংসিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আইটিসি ইনফোটেকের মতো কোম্পানিতে কর্মীরা কাজ-জীবনের ভারসাম্যের জন্য ৩.৯/৫ রেটিং দিয়েছেন, যা শিল্পের গড়ের তুলনায় বেশি। একজন কর্মী তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেছেন, “কোম্পানির সংস্কৃতি শেখার এবং বৃদ্ধির প্রচার করে, এবং সহকর্মীরা একে অপরকে সাহায্য করতে প্রস্তুত।”

   

এছাড়া, টেক মাহিন্দ্রার মতো কোম্পানি তাদের সহায়ক ব্যবস্থাপনা এবং কাজ-জীবনের ভারসাম্যের জন্য পরিচিত। একজন প্রাক্তন কর্মী বলেন, “টেক মাহিন্দ্রায় নমনীয় কাজের সময় এবং দলগত কার্যক্রম আমাকে উৎপাদনশীল এবং সন্তুষ্ট রাখত।” বড় কোম্পানিগুলোতে প্রায়ই কর্মীদের জন্য টিম-বিল্ডিং ইভেন্ট, স্থানীয় ছুটির উদযাপন, এবং শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়, যা একটি ইতিবাচক কাজের পরিবেশ তৈরি করে।

কলকাতার আইটি কোম্পানিগুলোতে আরও কিছু সুবিধা হলো:

  • কম খরচে জীবনযাপন: কলকাতার জীবনযাত্রার খরচ বেঙ্গালুরু বা মুম্বাইয়ের তুলনায় কম, যা কর্মীদের জন্য আর্থিক চাপ কমায়।
  • নমনীয় কাজের ব্যবস্থা: অনেক কোম্পানি, যেমন আইবিএম, হাইব্রিড বা ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম বিকল্প চালু করেছে, যা কাজ-জীবনের ভারসাম্য উন্নত করছে।
  • শিক্ষার সুযোগ: কলকাতার আইটি কোম্পানিগুলো প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম এবং দক্ষতা উন্নয়নের উপর জোর দেয়, যা তরুণ পেশাদারদের জন্য আকর্ষণীয়।

কলকাতার আইটি কাজের পরিবেশ: বিষাক্ত দিকগুলো
তবে, সব গল্প ইতিবাচক নয়। কিছু কোম্পানিতে কর্মীরা বিষাক্ত কাজের পরিবেশের অভিযোগ তুলেছেন। উদাহরণস্বরূপ, পিডব্লিউসি (PwC)-এর কলকাতা শাখায় একজন সফটওয়্যার ডেভেলপার ২০১৮ সালে গ্লাসডোরে লিখেছেন, “আইটি শিল্পে যোগ দেওয়ার জন্য এই কোম্পানি এড়িয়ে চলুন। কোনো প্রকল্প না থাকলেও সফটওয়্যার ডেভেলপারদের রাত ৩টা পর্যন্ত পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে হয়। কাজ-জীবনের ভারসাম্য বলতে কিছু নেই।”

একইভাবে, একটি রেডিট পোস্টে কলকাতার একটি আইটি কোম্পানির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে যেখানে “মিডল স্কুলের মতো পরিবেশ” ছিল, এবং সিটিও-এর আত্মীয় কাজ না করে অন্যদের সমালোচনা করতেন। এই ধরনের অভিজ্ঞতায় বিষাক্ততার উপাদানগুলো হলো:

  • মাইক্রোম্যানেজমেন্ট: অনেক কর্মী অভিযোগ করেছেন যে তাদের বসরা অতিরিক্ত তদারকি করেন এবং ছোটখাটো ভুলের উপর অতিরিক্ত জোর দেন।
  • দীর্ঘ কাজের সময়: কিছু কোম্পানিতে কর্মীদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়, যা শারীরিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।
  • অপর্যাপ্ত প্রকল্প: কলকাতায় আইটি কোম্পানির সংখ্যা বেঙ্গালুরু বা হায়দরাবাদের তুলনায় কম, ফলে কিছু কোম্পানিতে প্রকল্পের অভাবে কর্মীরা অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যস্ত থাকেন।
  • বেতনের বৈষম্য: কলকাতায় আইটি কর্মীদের বেতন অন্যান্য মেট্রো শহরের তুলনায় কম, যা কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।

বাস্তব গল্প: কর্মীদের অভিজ্ঞতা

Advertisements
  • সুপর্ণা মুখার্জি, টিসিএস, সল্টলেক: “টিসিএস-এ আমার অভিজ্ঞতা বেশ ভালো। আমরা প্রকল্পের সময় কঠোর পরিশ্রম করি, তবে ব্যবস্থাপনা সহায়ক। আমরা নিয়মিত টিম ইভেন্টে অংশ নিই, এবং কোম্পানি আমাদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়। তবে, কাজের চাপ মাঝে মাঝে বেশি হয়, বিশেষ করে ক্লায়েন্ট ডেডলাইনের সময়।”
  • অর্জুন দাস, স্টার্টআপ, নিউ টাউন: “আমি একটি ছোট আইটি স্টার্টআপে কাজ করি, এবং পরিবেশ খুবই বিষাক্ত। আমার ম্যানেজার মাইক্রোম্যানেজ করেন এবং ছোট ভুলের জন্য আমাকে দোষারোপ করেন। আমরা সপ্তাহান্তেও কাজ করি, এবং কোনো অতিরিক্ত বেতন দেওয়া হয় না। আমি বেঙ্গালুরুতে চাকরি খুঁজছি।”
  • প্রিয়া সেন, আইবিএম, কলকাতা: “আইবিএম-এ কাজের পরিবেশ বেশ ভালো। আমরা ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম সুবিধা পাই, এবং আমার টিম খুব সহায়ক। তবে, কলকাতায় প্রকল্পের তুলনায় বেঙ্গালুরু বা পুনের শাখায় বেশি সুযোগ রয়েছে, যা মাঝে মাঝে হতাশার কারণ হয়।”

কলকাতার আইটি কাজের পরিবেশের বৈশিষ্ট্য
কলকাতার আইটি কাজের পরিবেশ অনেকাংশে কোম্পানির আকার এবং প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো (যেমন টিসিএস, উইপ্রো) সাধারণত আরও কাঠামোগত এবং সহায়ক পরিবেশ প্রদান করে, যেখানে নমনীয় কাজের ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ, এবং কর্মী কল্যাণ প্রোগ্রাম রয়েছে। তবে, ছোট কোম্পানি বা স্টার্টআপগুলোতে প্রায়ই অতিরিক্ত কাজের চাপ, অপর্যাপ্ত বেতন, এবং মাইক্রোম্যানেজমেন্টের অভিযোগ উঠে।

কলকাতার আইটি সেক্টরে কাজ-জীবনের ভারসাম্য একটি মিশ্র ছবি উপস্থাপন করে। যেখানে কিছু কোম্পানি নমনীয় সময় এবং দূরবর্তী কাজের সুযোগ দেয়, সেখানে অন্যান্য কোম্পানিতে কর্মীদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়। একটি রেডিট পোস্টে একজন কর্মী বলেছেন, “কলকাতায় বেতন কম, এবং এটি একটি নিম্ন-আয়ের ফাঁদ তৈরি করেছে, যা দক্ষ কর্মীদের শহর ছাড়তে বাধ্য করে।”

ভারতের আইটি কাজের পরিবেশের প্রেক্ষাপটে কলকাতা
ভারতের আইটি শিল্পে বিষাক্ত কাজের পরিবেশ নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। ২০২৪ সালে আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং (ইওয়াই)-এর একজন কর্মীর মৃত্যু কাজের চাপের কারণে আলোচনায় এসেছিল, যা ভারতের কর্পোরেট সেক্টরে বিষাক্ততার বিষয়টি তুলে ধরে। কলকাতার ক্ষেত্রে এই সমস্যা ততটা তীব্র নাও হতে পারে, তবে কিছু কোম্পানিতে অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা এখনও একটি সমস্যা।

তবে, কলকাতার আইটি সেক্টর বেঙ্গালুরু বা হায়দরাবাদের তুলনায় কম প্রতিযোগিতামূলক, যা কিছু ক্ষেত্রে কাজের চাপ কমায়। একজন কোয়োরা ব্যবহারকারী বলেছেন, “কলকাতার আইটি কোম্পানিগুলোতে কাজের পরিবেশ এখন আর শহর-নির্দিষ্ট নয়। বড় কোম্পানিগুলোতে পরিবেশ অনেকটা বেঙ্গালুরুর মতোই।”

উন্নতির পথে পদক্ষেপ
কলকাতার আইটি কোম্পানিগুলোতে কাজের পরিবেশ উন্নত করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

  • মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা: কর্মীদের জন্য ইমপ্লয়ি অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম (ইএপি) এবং মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের ব্যবস্থা।
  • নমনীয় কাজের নীতি: হাইব্রিড কাজের মডেল এবং নির্ধারিত কাজের সময় কঠোরভাবে মেনে চলা।
  • স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা: মাইক্রোম্যানেজমেন্ট কমিয়ে কর্মীদের উপর ভরসা রাখা এবং তাদের কাজের স্বাধীনতা দেওয়া।
  • বেতন সমতা: কলকাতার আইটি কর্মীদের বেতন অন্যান্য মেট্রো শহরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা।

কলকাতার আইটি কোম্পানিগুলোর কাজের পরিবেশ একটি মিশ্র চিত্র উপস্থাপন করে। বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো সাধারণত সহায়ক পরিবেশ, নমনীয় কাজের ব্যবস্থা, এবং শিক্ষার সুযোগ প্রদান করে। তবে, ছোট কোম্পানি বা কিছু নির্দিষ্ট সংস্থায় বিষাক্ত কাজের পরিবেশ, মাইক্রোম্যানেজমেন্ট, এবং কাজ-জীবনের ভারসাম্যহীনতার অভিযোগ রয়েছে। কলকাতার আইটি সেক্টরের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে, কোম্পানিগুলোকে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য, ন্যায্য বেতন, এবং স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার উপর জোর দিতে হবে। কর্মীদের বাস্তব গল্প থেকে এটি স্পষ্ট যে, কলকাতার আইটি কাজের পরিবেশ সংস্থার উপর নির্ভর করে ব্যাপকভাবে ভিন্ন হয়।