ভারতীয় স্টার্টআপ (Indian Startups) ইকোসিস্টেম, যা একসময় বিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন এবং বিনিয়োগকারীদের উৎসাহে উজ্জ্বল ছিল, ২০২৫ সালে একটি গভীর ফান্ডিং উইন্টারের (funding winter) মুখোমুখি হচ্ছে। এই বছরের প্রথমার্ধে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (VC) ফান্ডিং ১১% হ্রাস পেয়েছে, যা ২০২৪ সালের প্রথমার্ধের $৬.৪ বিলিয়ন থেকে কমে $৫.৭ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। এপ্রিল ২০২৫-এ ফান্ডিং আরও কমে $৭৪৫ মিলিয়নে পৌঁছেছে, যা বছরের সর্বনিম্ন এবং ২০২৪ সালের এপ্রিলের তুলনায় ৩৪.৬৫% কম। এই ফান্ডিং সংকটের পিছনে রয়েছে বৈশ্বিক এবং দেশীয় অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বড় আকারের ডিলের অভাব এবং বিনিয়োগকারীদের সতর্ক মনোভাব। এই নিবন্ধে আমরা ভারতীয় স্টার্টআপগুলোর ফান্ডিং উইন্টারের কারণ, এর প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
ফান্ডিং উইন্টারের কারণ
১. বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা: ২০২৫ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতি মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের উত্তেজনা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর শুল্ক নীতির মতো ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে। এই অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা হ্রাস করেছে, ফলে স্টার্টআপগুলোতে মূলধন প্রবাহ কমেছে।
২. বড় আকারের ডিলের অভাব: ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে $১০০ মিলিয়ন বা তার বেশি মূল্যের ডিলের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে ১০টি বড় ডিল হয়েছিল, কিন্তু ২০২৫ সালে এটি কমে মাত্র ৫টিতে দাঁড়িয়েছে। এরিশা ই মোবিলিটি ($১ বিলিয়ন) এবং গ্রিনলাইন ($২৭৫ মিলিয়ন) এর মতো কয়েকটি বড় ডিল ছাড়া বেশিরভাগ ফান্ডিং ছোট এবং মাঝারি আকারের ছিল।
৩. বিনিয়োগকারীদের সতর্কতা: বিনিয়োগকারীরা এখন লাভজনকতা এবং টেকসই ব্যবসায়িক মডেলের উপর বেশি জোর দিচ্ছেন, হাইপার-গ্রোথ বা উচ্চ মূল্যায়নের উপর নয়। ২০২১-এর মতো বড় অঙ্কের ফান্ডিংয়ের সময়কাল আর নেই, যখন $৪১.৬ বিলিয়ন বিনিয়োগ হয়েছিল। বর্তমানে, বিনিয়োগকারীরা ছোট, প্রাথমিক পর্যায়ের ডিলে বেশি আগ্রহী, যেখানে ঝুঁকি কম এবং মূল্যায়ন বাস্তবসম্মত।
৪. এআই এবং নতুন প্রযুক্তির অনিশ্চয়তা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং ডিপটেকের মতো উদীয়মান প্রযুক্তির উত্থান বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। তারা এখনও এই প্রযুক্তিগুলোর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এবং লাভের সম্ভাবনা নিয়ে মূল্যায়ন করছে, যা ফান্ডিং বিলম্বিত করছে।
৫. দেশীয় মূলধনের অভাব: ভারতীয় স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম বিদেশী মূলধনের উপর বেশি নির্ভরশীল। দেশীয় পেনশন ফান্ড এবং ব্যাংকগুলো প্রযুক্তি বা স্টার্টআপে বিনিয়োগে অনীহা প্রকাশ করছে। রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার সাম্প্রতিক নিয়মে ব্যাংক এবং নন-ব্যাংকিং ফাইনান্সিয়াল কোম্পানিগুলোর অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডে (AIF) বিনিয়োগ সীমিত করা হয়েছে, যা ফান্ডিং সংকটকে আরও তীব্র করেছে।
ফান্ডিং উইন্টারের প্রভাব
১. কর্মী ছাঁটাই ও ব্যবসা বন্ধ: ফান্ডিং কমে যাওয়ায় অনেক স্টার্টআপ খরচ কমাতে এবং লাভজনকতার দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়েছে। ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতের টেক স্টার্টআপগুলোতে প্রায় ১৭,০০০ কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। বিশেষত, বাইজু’স এবং ডানজোর মতো বড় স্টার্টআপগুলো ফান্ডিং সংকটের কারণে একাধিকবার ছাঁটাই এবং বেতন বিলম্বের সম্মুখীন হয়েছে।
২. গ্রোথ-স্টেজ ফান্ডিংয়ে হ্রাস: গ্রোথ-স্টেজ স্টার্টআপগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কারণ বিনিয়োগকারীরা এখন প্রাথমিক এবং মাঝারি পর্যায়ের ডিলে বেশি আগ্রহী। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে গ্রোথ-স্টেজ ফান্ডিং $১.৯ বিলিয়ন, যা ২০২৪ সালের তুলনায় কম।
৩. ইউনিকর্ন সংখ্যা হ্রাস: ২০২৫ সালে ইউনিকর্ন (মূল্যায়ন $১ বিলিয়ন বা তার বেশি) স্টার্টআপের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০২৪ সালে ৬টি ইউনিকর্ন তৈরি হয়েছিল, কিন্তু ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত মাত্র জেটা ($২ বিলিয়ন মূল্যায়ন) একটি নতুন ইউনিকর্ন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
৪. বাজার সংশোধন: ফান্ডিং উইন্টার স্টার্টআপগুলোকে তাদের ব্যবসায়িক মডেল পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করছে। অনেকে এখন হাইপার-গ্রোথের পরিবর্তে লাভজনকতা এবং ইউনিট ইকোনমিক্সের উপর জোর দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, আরবান কোম্পানি ২০২৪ সালে লাভজনক হয়েছে এবং মিশো তাদের সদর দপ্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে স্থানান্তর করেছে, যা টেকসই বৃদ্ধির প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি দেখায়।
উজ্জ্বল দিক এবং পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা
ফান্ডিং উইন্টার সত্ত্বেও, ভারতীয় স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম কিছু ইতিবাচক লক্ষণ দেখাচ্ছে:
১. নির্বাচিত সেক্টরে বৃদ্ধি: ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড লজিস্টিক্স টেক ($১.৬ বিলিয়ন) এবং রিটেইল ($১.২ বিলিয়ন) ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে উল্লেখযোগ্য ফান্ডিং আকর্ষণ করেছে। কুইক কমার্স, যেমন জেপটো, $১.৩৫৫ বিলিয়ন সংগ্রহ করেছে, যা এই সেক্টরের সম্ভাবনা দেখায়।
২. আইপিও এবং এক্সিট মোমেন্টাম: ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ১৫২টি আইপিও হয়েছে, যা ২০২৪ সালের তুলনায় কম হলেও বিনিয়োগকারীদের জন্য এক্সিটের সুযোগ তৈরি করছে। পিক এক্সভি পার্টনার্স, অ্যাক্সেল এবং টাইগার গ্লোবালের মতো বড় ভেঞ্চার ফান্ডগুলো আইপিওর মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য রিটার্ন পেয়েছে।
৩. নীতিগত সংস্কার: ভারত সরকার অ্যাঞ্জেল ট্যাক্স বিলোপ, দীর্ঘমেয়াদী মূলধন লাভ কর হ্রাস এবং বিদেশী ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগকারীদের জন্য নিবন্ধন প্রক্রিয়া সরলীকরণের মতো সংস্কার চালু করেছে। এই পদক্ষেপগুলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে পারে।
৪. উদীয়মান সেক্টর: ক্লাইমেট টেক, ডিপটেক, এআই, এবং স্পেসটেকের মতো সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়ছে। জেনারেটিভ এআই স্টার্টআপগুলো ২০২০ সালে $২৭৭ মিলিয়ন থেকে ২০২৪ সালে $১.২ বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে, যা ২০২৫ সালে আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখায়।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
১. দেশীয় মূলধন বৃদ্ধি: দেশীয় পেনশন ফান্ড এবং ব্যাংকগুলোর জন্য স্টার্টআপে বিনিয়োগের প্রণোদনা তৈরি করা প্রয়োজন। সরকারের স্টার্টআপ ইন্ডিয়া সিড ফান্ড স্কিম এবং এসআইডিবিআই ফান্ড অফ ফান্ডস এই দিকে কাজ করছে, তবে এর পরিধি বাড়ানো দরকার।
২. টেকসই ব্যবসায়িক মডেল: স্টার্টআপগুলোকে লাভজনকতা এবং শক্তিশালী ইউনিট ইকোনমিক্সের উপর জোর দিতে হবে। ইয়ারবান কোম্পানি এবং মিশোর মতো কোম্পানিগুলো এই পথে এগিয়ে গেছে।
৩. অল্টারনেটিভ ফান্ডিং চ্যানেল: মাইক্রো ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, ফ্যামিলি অফিস এবং কর্পোরেট ফান্ডগুলো প্রাথমিক পর্যায়ের স্টার্টআপগুলোর জন্য বিকল্প ফান্ডিং সোর্স হতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞদের মতে, ফান্ডিং উইন্টার আরও কয়েক ত্রৈমাসিক ধরে চলতে পারে, তবে ২০২৫ সালের শেষের দিকে পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা রয়েছে। ইনক৪২ এর বার্ষিক ফান্ডিং রিপোর্ট অনুসারে, ২০২৫ সালে মোট ফান্ডিং ২৫% বৃদ্ধি পেয়ে $১৫ বিলিয়নে পৌঁছতে পারে। বেঙ্গালুরু, দিল্লি-এনসিআর এবং মুম্বাই ফান্ডিংয়ের কেন্দ্র হিসেবে আধিপত্য বজায় রাখবে, তবে চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ এবং পুনের মতো শহরগুলোতেও ক্রমশ বিনিয়োগ বাড়তে পারে।
২০২৫ সালে ভারতীয় স্টার্টআপগুলো ফান্ডিং উইন্টারের মুখোমুখি হলেও, এটি একটি বাজার সংশোধন হিসেবে কাজ করছে, যা টেকসই এবং মান-চালিত উদ্যোগকে পুরস্কৃত করবে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং দেশীয় চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, কুইক কমার্স, এআই এবং ডিপটেকের মতো সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়ছে। সরকারি সংস্কার, বিকল্প ফান্ডিং চ্যানেল এবং লাভজনকতার উপর জোর দিয়ে ভারতীয় স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম এই উইন্টার কাটিয়ে উঠতে পারে এবং ২০২৫ সালের শেষে একটি শক্তিশালী পুনরুদ্ধারের পথে এগিয়ে যেতে পারে।