কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী এবং ভারতের অন্যতম বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, সবসময়ই তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে চাকরির জন্য ফ্রেশারদের (IT Fresher Jobs) কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। তবে, ২০২৫ সালে কলকাতায় আইটি ফ্রেশারদের জন্য চাকরির বাজার কতটা প্রতিযোগিতামূলক? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমরা বিভিন্ন তথ্য, কৃষকদের অভিজ্ঞতা এবং শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতামত বিশ্লেষণ করেছি। এই প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করব কলকাতার আইটি চাকরির বাজারের বর্তমান অবস্থা, ফ্রেশারদের জন্য সুযোগ, প্রতিযোগিতার মাত্রা এবং কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করা যায়।
কলকাতার আইটি চাকরির বাজার: একটি ওভারভিউ
কলকাতা ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আইটি হাব হিসেবে পরিচিত। সেক্টর-৫, সল্টলেক এবং নিউটাউনের মতো এলাকায় অবস্থিত বহুজাতিক কোম্পানি (এমএনসি) যেমন টিসিএস, ইনফোসিস, উইপ্রো, কগনিজেন্ট, আইবিএম, এবং অ্যাকসেনচার ফ্রেশারদের জন্য বিভিন্ন চাকরির সুযোগ প্রদান করছে। ২০২৫ সালে কলকাতায় আইটি চাকরির বাজারে প্রায় ৩০০-৫০০টি ফ্রেশার চাকরির সুযোগ রয়েছে, যা বিই, বিটেক, এমসিএ, বিসিএ, এবং কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতকদের জন্য উন্মুক্ত। এই চাকরিগুলোর মধ্যে রয়েছে সফটওয়্যার ডেভেলপার, আইটি সাপোর্ট স্পেশালিস্ট, ডেটা অ্যানালিস্ট, কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স টেস্টার এবং নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ারের মতো পদ।
তবে, এই সুযোগের পাশাপাশি প্রতিযোগিতাও তীব্র। কলকাতায় প্রতি বছর হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আইটি সংক্রান্ত স্নাতক বের হচ্ছেন, এবং তাঁদের মধ্যে অনেকেই শীর্ষস্থানীয় এমএনসি-তে চাকরির জন্য আবেদন করছেন। উদাহরণস্বরূপ, ইনফোসিস এবং টিসিএস-এর মতো কোম্পানিগুলো প্রতি বছর কলকাতায় ফ্রেশারদের জন্য ৫০০-১০০০টি পদে নিয়োগ করে, কিন্তু আবেদনকারীর সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক হয়। এই তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেকে আলাদা করে তুলতে ফ্রেশারদের বিশেষ দক্ষতা এবং প্রস্তুতির প্রয়োজন।
প্রতিযোগিতার মাত্রা: কী বলছে তথ্য?
২০২৫ সালে কলকাতায় আইটি ফ্রেশার চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা বেশ তীব্র। গ্লাসডোরের তথ্য অনুযায়ী, কলকাতায় প্রায় ২৮৬টি ফ্রেশার আইটি চাকরির সুযোগ রয়েছে, যার মধ্যে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, এবং আইটি সাপোর্টের মতো পদগুলো জনপ্রিয়। তবে, প্রতিটি পদের জন্য গড়ে ১০০-১৫০ জন আবেদনকারী থাকেন, যা প্রতিযোগিতার তীব্রতা নির্দেশ করে। ইনডিড-এর তথ্য অনুযায়ী, কলকাতায় আইটি সেক্টরে ফ্রেশারদের জন্য মাসিক বেতন ৮,০০০ থেকে ৩৫,০০০ টাকার মধ্যে, যা দক্ষতা এবং কোম্পানির উপর নির্ভর করে।
ইন্টার্নশালার তথ্য অনুযায়ী, কলকাতায় আইটি ফ্রেশার চাকরির বেতন পরিসীমা মাসিক ৯,৯৭৫ থেকে ৯৮,৮৮১ টাকা পর্যন্ত হতে পারে, যা কোম্পানি এবং পদের উপর নির্ভর করে। তবে, এই উচ্চ বেতনের পদগুলোর জন্য প্রোগ্রামিং ভাষায় (যেমন পাইথন, জাভা, সি++) দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা এবং নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, ওয়েবলি টেকনোলজিস এবং ইনোফাইডের মতো কোম্পানিগুলো ফ্রেশারদের জন্য ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এবং সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পদে নিয়োগ করছে, তবে তাঁদের কাছে শক্তিশালী যোগাযোগ দক্ষতা এবং ৩৬ মাসের চাকরির প্রতিশ্রুতি প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
প্রতিযোগিতার মূল কারণ
কলকাতায় আইটি ফ্রেশার চাকরির প্রতিযোগিতার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক স্নাতক (বিই, বিটেক, এমসিএ, বিসিএ) কলকাতার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বের হচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, কলকাতার আইটি হাব হিসেবে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের কারণে বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ বা পুনের মতো শহর থেকে ফ্রেশাররা এখানে চাকরির জন্য আসছেন। তৃতীয়ত, কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে রিমোট এবং হাইব্রিড কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায়, অনেক কোম্পানি ফ্রেশারদের জন্য সীমিত সংখ্যক পদ অফার করছে।
টিসিএস, ইনফোসিস এবং উইপ্রোর মতো শীর্ষ আইটি কোম্পানিগুলো ২০২৫ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে নিয়োগ কমিয়েছে, যা ফ্রেশারদের জন্য প্রতিযোগিতা আরও বাড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, কোম্পানিগুলো এমন প্রার্থীদের প্রাধান্য দিচ্ছে যাঁদের হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা, ইন্টার্নশিপ বা প্রোজেক্ট-ভিত্তিক দক্ষতা রয়েছে।
কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন ফ্রেশাররা?
কলকাতায় আইটি ফ্রেশার চাকরির প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে কিছু কৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন। প্রথমত, প্রোগ্রামিং ভাষা যেমন পাইথন, জাভা, সি++, এবং জাভাস্ক্রিপ্টে দক্ষতা অর্জন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, ক্লাউড কম্পিউটিং (AWS, Azure), ডেটা অ্যানালিটিক্স, এবং সাইবার সিকিউরিটির মতো নতুন প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণ নেওয়া ফ্রেশারদের আলাদা করে তুলতে পারে। তৃতীয়ত, ইন্টার্নশালা, নৌকরি, এবং লিঙ্কডইনের মতো প্ল্যাটফর্মে নিয়মিত চাকরির সুযোগ খোঁজা এবং আবেদন করা জরুরি।
এছাড়া, যোগাযোগ দক্ষতা এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা উন্নত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক কোম্পানি, যেমন পিডব্লিউসি এবং ইওয়াই, ফ্রেশারদের কাছে শক্তিশালী বিশ্লেষণী ক্ষমতা এবং টিমওয়ার্কের দক্ষতা প্রত্যাশা করে। ফ্রেশাররা ইন্টার্নশিপ বা ফ্রিল্যান্স প্রোজেক্টের মাধ্যমে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন, যা তাঁদের সিভিতে ওজন যোগ করবে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
কলকাতায় আইটি ফ্রেশার চাকরির বাজারে চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে সীমিত পদের তুলনায় অধিক আবেদনকারী, ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব, এবং কিছু ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা। তবে, কলকাতার আইটি খাত ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এবং ডিজিটাল ইন্ডিয়া উদ্যোগের ফলে নতুন স্টার্টআপ এবং আইটি কোম্পানিগুলো কলকাতায় বিনিয়োগ করছে। এছাড়া, সিডিএসি এবং এনআইসির মতো সরকারি সংস্থাগুলোও ফ্রেশারদের জন্য সুযোগ তৈরি করছে।
২০২৫ সালে কলকাতায় আইটি ফ্রেশার চাকরির বাজার প্রতিযোগিতামূলক হলেও সুযোগের অভাব নেই। সঠিক দক্ষতা, প্রশিক্ষণ, এবং প্রস্তুতির মাধ্যমে ফ্রেশাররা এই বাজারে সাফল্য অর্জন করতে পারেন। পাইথন, ক্লাউড কম্পিউটিং, এবং ডেটা অ্যানালিটিক্সের মতো দক্ষতায় বিনিয়োগ করা এবং ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করা ফ্রেশারদের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখবে। কলকাতার ক্রমবর্ধমান আইটি হাব হিসেবে উত্থান এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমর্থনে, ফ্রেশারদের জন্য ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, তবে সাফল্যের জন্য কঠোর পরিশ্রম এবং প্রস্তুতি অপরিহার্য।