চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা! কলকাতার বিপিও চাকরির বাজারে এআই ও অটোমেশনের প্রভাব

ভারতের ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া আউটসোর্সিং (বিপিও) শিল্পে কলকাতা দীর্ঘদিন ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ (Kolkata BPO Job) কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং অটোমেশনের…

How AI & Automation Are Transforming Kolkata BPO Job Marke

ভারতের ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া আউটসোর্সিং (বিপিও) শিল্পে কলকাতা দীর্ঘদিন ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ (Kolkata BPO Job) কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং অটোমেশনের দ্রুত প্রসারের ফলে এই শিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। বিশেষ করে কলকাতার বিপিও চাকরির বাজারে এআই এবং অটোমেশনের প্রভাব একদিকে দক্ষতা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। এই প্রতিবেদনে আমরা কলকাতার বিপিও শিল্পে এআই ও অটোমেশনের প্রভাব, এর ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ এবং নতুন সম্ভাবনাগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

   

কলকাতার বিপিও শিল্পে এআই ও অটোমেশনের প্রভাব

কলকাতা ভারতের অন্যতম প্রধান বিপিও হাব হিসেবে পরিচিত, যেখানে টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (টিসিএস), উইপ্রো, কগনিজেন্ট এবং জেনপ্যাক্টের মতো বড় কোম্পানিগুলো কল সেন্টার, ডেটা এন্ট্রি, গ্রাহক সহায়তা এবং আইটি সেবা প্রদান করে। তবে, এআই এবং অটোমেশনের প্রবর্তনের ফলে এই শিল্পের গতিপ্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। ম্যাককিন্সির একটি প্রতিবেদন অনুসারে, এআই ৬০-৭০% পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ স্বয়ংক্রিয় করতে পারে, যার মধ্যে কল সেন্টারের গ্রাহক সহায়তা, ডেটা এন্ট্রি এবং আইটি সাপোর্টের মতো কাজ অন্তর্ভুক্ত।

কল সেন্টারে এআই: দক্ষতা বৃদ্ধি ও চাকরির ঝুঁকি

কলকাতার কল সেন্টারগুলোতে এআই-চালিত চ্যাটবট এবং ভার্চুয়াল সহকারী ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রযুক্তিগুলো গ্রাহকের প্রশ্নের দ্রুত উত্তর প্রদান, সেন্টিমেন্ট বিশ্লেষণ এবং কল সারাংশ তৈরিতে অত্যন্ত দক্ষ। উদাহরণস্বরূপ, টেক মাহিন্দ্রার মতো কোম্পানি এআই-চালিত স্পিচ অ্যানালিটিক্স ব্যবহার করে গ্রাহকের কথোপকথন পর্যালোচনা করছে, যা খরচ কমিয়েছে এবং দক্ষতা বাড়িয়েছে। তবে, এই প্রযুক্তি কল সেন্টারের প্রায় ৩০-৫০% কথোপকথন স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালনা করতে পারে, যা নিম্ন-দক্ষতার চাকরির জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে।

টিসিএস-এর সাম্প্রতিক ১২,২০০ চাকরি ছাঁটাইয়ের ঘোষণা কলকাতার বিপিও কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে মধ্যম এবং সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের কর্মীরা এই ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। একজন কলকাতার টিসিএস কর্মী বলেন, “৪৫ বছর বয়সে নতুন চাকরি পাওয়া খুবই কঠিন।” এই ছাঁটাইগুলো এআই গ্রহণ এবং দক্ষতার অমিলের ফলাফল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

চাকরির বাজারে চ্যালেঞ্জ

১. চাকরির ক্ষয়: কলকাতার বিপিও শিল্পে পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ, যেমন গ্রাহক সহায়তা, ডেটা এন্ট্রি এবং ম্যানুয়াল টেস্টিং, এআই দ্বারা স্বয়ংক্রিয় হচ্ছে। নাসকমের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের বিপিও শিল্পে প্রায় ৫.৪ মিলিয়ন মানুষ নিযুক্ত, এবং এআই এই শিল্পের নিম্ন-দক্ষতার চাকরিগুলোকে হুমকির মুখে ফেলছে। কলকাতায়, যেখানে বিপিও শিল্প তরুণদের জন্য বড় চাকরির উৎস, এই প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

২. দক্ষতার অমিল: এআই এবং অটোমেশনের কারণে ঐতিহ্যবাহী দক্ষতা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। যেমন, কল সেন্টারের কর্মীদের মধ্যে যারা শুধুমাত্র গ্রাহক সহায়তা প্রদান করেন, তাদের চাকরি এআই চ্যাটবট দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ২-৩ বছরে ৪,০০,০০০ থেকে ৫,০০,০০০ চাকরি হারিয়ে যেতে পারে, যার মধ্যে ৭০% মধ্যম-দক্ষতার কর্মীদের।

৩. মানসিক চাপ: কলকাতার বিপিও কর্মীদের মধ্যে চাকরির অনিশ্চয়তা এবং নতুন দক্ষতা শেখার চাপ বাড়ছে। টিসিএস-এর নতুন “বেঞ্চ পলিসি” এবং পারফরম্যান্স বোনাসের হ্রাসও কর্মীদের মনোবল কমিয়েছে।

Advertisements

নতুন সম্ভাবনা ও সুযোগ

এআই এবং অটোমেশন শুধু চাকরি হ্রাসই করছে না, বরং নতুন সুযোগও তৈরি করছে। কলকাতার বিপিও শিল্পে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে নতুন চাকরির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে:
১. নতুন চাকরির ভূমিকা: এআই বাস্তবায়নের জন্য ডেটা বিশ্লেষক, মেশিন লার্নিং ইঞ্জিনিয়ার, এআই কনভারসেশন ডিজাইনার এবং চ্যাটবট প্রশিক্ষকের মতো নতুন ভূমিকা তৈরি হচ্ছে। নাসকমের প্রতিবেদন অনুসারে, বিপিও শিল্প ৬-৭% বার্ষিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং এআই দক্ষতার চাহিদা বাড়ছে।

২. ফিজিটাল মডেল: টেক মাহিন্দ্রার মতো কোম্পানি “ফিজিটাল” মডেল গ্রহণ করছে, যেখানে এআই এবং মানুষের দক্ষতা একত্রিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, এআই গ্রাহকের মুড বিশ্লেষণ করে এবং মানুষ সংবেদনশীল কথোপকথন পরিচালনা করে। এই মডেল কলকাতার বিপিও কর্মীদের জন্য নতুন দক্ষতা শেখার সুযোগ তৈরি করছে।

৩. পুনঃদক্ষতা প্রোগ্রাম: ভারত সরকারের “স্কিল ইন্ডিয়া” এবং “ডিজিটাল ইন্ডিয়া” প্রকল্প কলকাতার কর্মীদের এআই এবং ডেটা বিশ্লেষণে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ডব্লিউএনএস-এর মতো কোম্পানি ইতিমধ্যে ২২,০০০ কর্মীকে এআই দক্ষতায় প্রশিক্ষিত করেছে।

কলকাতায় এআই-এর ভবিষ্যৎ

কলকাতার বিপিও শিল্পে এআই এবং অটোমেশনের প্রভাব একটি দ্বিমুখী তলোয়ার। একদিকে, এটি নিম্ন-দক্ষতার চাকরির জন্য হুমকি, অন্যদিকে নতুন দক্ষতা এবং ভূমিকার জন্য সুযোগ তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কলকাতার তরুণ কর্মীদের এআই, ডেটা বিশ্লেষণ এবং মেশিন লার্নিংয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা এই রূপান্তরকে সহজ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতায় ইতিমধ্যে এআই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে উঠছে, যা নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করছে।

কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?

কলকাতার বিপিও কর্মীদের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা জরুরি:
দক্ষতা উন্নয়ন: Coursera, Udemy বা Google Digital Garage-এর মতো প্ল্যাটফর্মে এআই, ডেটা বিশ্লেষণ এবং ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের কোর্স করুন।
প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ: স্কিল ইন্ডিয়া বা ফিউচার স্কিলস প্রাইমের মতো প্রোগ্রামে যোগ দিন।
নেটওয়ার্কিং: LinkedIn-এ প্রোফাইল তৈরি করে এআই-ভিত্তিক চাকরির সুযোগ খুঁজুন।
স্থানীয় সুযোগ: কলকাতার স্থানীয় আইটি হাব যেমন সল্টলেক সেক্টর V-তে স্টার্টআপ এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

কলকাতার বিপিও চাকরির বাজারে এআই এবং অটোমেশনের প্রভাব একটি রূপান্তরের সূচনা করেছে। যদিও এটি নিম্ন-দক্ষতার চাকরির জন্য হুমকি, তবে নতুন দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মীরা এই পরিবর্তনের সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। সরকার, শিল্প এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে কলকাতা এআই-চালিত ভবিষ্যতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই রূপান্তরে সফল হতে হলে পুনঃদক্ষতা এবং নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা অত্যন্ত জরুরি।