পশ্চিমবঙ্গ কি বেঙ্গালুরুর পরে ভারতের পরবর্তী আইটি হাব হতে পারে?

বেঙ্গালুরু ভারতের ‘সিলিকন ভ্যালি’ নামে পরিচিত, গত কয়েক দশকে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে আধিপত্য বিস্তার করেছে। তবে, পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে কলকাতা এবং তার…

Can West Bengal Emerge as India’s Next IT Hub After Bengaluru? Exploring Bengal Tech Growth

বেঙ্গালুরু ভারতের ‘সিলিকন ভ্যালি’ নামে পরিচিত, গত কয়েক দশকে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে আধিপত্য বিস্তার করেছে। তবে, পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে কলকাতা এবং তার আশেপাশের এলাকা, সম্প্রতি আইটি শিল্পের বৃদ্ধির সম্ভাবনা (Bengal Tech Growth) নিয়ে আলোচনায় এসেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে রাজ্য সরকারের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা, যেমন নিউ টাউনের ‘বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি’ প্রকল্প এবং ব্যবসা-বান্ধব নীতিগুলো, পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের পরবর্তী আইটি হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। তবে, কি পশ্চিমবঙ্গ সত্যিই বেঙ্গালুরুর মতো একটি প্রযুক্তি কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে? এই প্রতিবেদনে আমরা পশ্চিমবঙ্গের আইটি বৃদ্ধির সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ এবং সাফল্যের সম্ভাব্য পথ নিয়ে আলোচনা করব।

পশ্চিমবঙ্গের আইটি খাত: বর্তমান অবস্থা
পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে আইটি খাতে প্রায় ২.৬ লক্ষ কর্মী নিযুক্ত রয়েছে, এবং রাজ্যে ১,০০০টিরও বেশি সফটওয়্যার এবং টেলিকম সংস্থা কাজ করছে, যেমন টিসিএস, উইপ্রো, কগনিজেন্ট, ইনফোসিস, রিলায়েন্স জিও, এবং এলটিআই মাইন্ডট্রি। রাজ্য সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে আইটি খাতে ৬০,০০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এছাড়া, রাজ্যের ২২টি আইটি পার্ক টিয়ার-২ এবং টিয়ার-৩ শহরে ৮৫% ক্ষমতায় কাজ করছে। নিউ টাউনের ‘বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি’ প্রকল্প, যা ২০১৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দ্বারা উদ্বোধন করা হয়েছিল, ২০২৬ সালের মধ্যে ২৫,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং ৪০,০০০ সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য রাখছে। টিসিএস এবং এলটিআই মাইন্ডট্রির মতো সংস্থাগুলো ইতিমধ্যে এই প্রকল্পে বড় ক্যাম্পাস নির্মাণ শুরু করেছে।

   

কেন পশ্চিমবঙ্গ একটি সম্ভাবনাময় আইটি হাব?
পশ্চিমবঙ্গে আইটি হাব হিসেবে উঠে আসার জন্য বেশ কয়েকটি সুবিধা রয়েছে:

  • দক্ষ মানবসম্পদ: পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর প্রচুর সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্রযুক্তি স্নাতক তৈরি হয়। আইআইটি খড়্গপুর, জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে দক্ষ প্রযুক্তি পেশাদাররা আইটি শিল্পের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করে।
  • সরকারি উদ্যোগ: রাজ্য সরকার আইটি শিল্পের জন্য ব্যবসা-বান্ধব নীতি, কর ছাড়, এবং ভর্তুকি প্রদান করছে। ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট (বিজিবিএস) ২০২৫’ এর মাধ্যমে রাজ্য তার বিনিয়োগ সম্ভাবনা প্রদর্শনের পরিকল্পনা করছে।
  • অবকাঠামো উন্নয়ন: নিউ টাউন এবং রাজারহাটে আধুনিক আইটি পার্ক এবং স্মার্ট সিটি প্রকল্পগুলো আইটি সংস্থাগুলোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করছে। এছাড়া, ২২টি আইটি পার্ক টিয়ার-২ শহরগুলোতে ছড়িয়ে রয়েছে, যা বিকেন্দ্রীভূত উন্নয়নকে উৎসাহিত করে।
  • জীবনযাত্রার খরচ: বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ বা গুরুগ্রামের তুলনায় কলকাতায় জীবনযাত্রার খরচ কম, যা আইটি পেশাদার এবং সংস্থাগুলোর জন্য আকর্ষণীয়।
    অবস্থানগত সুবিধা: কলকাতা একটি মেট্রোপলিটন শহর হিসেবে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সুবিধা প্রদান করে।

বেঙ্গালুরুর সঙ্গে তুলনা
বেঙ্গালুরু ভারতের আইটি রপ্তানির প্রায় ৩৫-৪০% অবদান রাখে এবং ১২,০০০টিরও বেশি আইটি সংস্থা এবং ১১,০০০টি স্টার্টআপের আবাসস্থল। এটি গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজনের মতো বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি জায়ান্টদের দক্ষিণ এশিয়ার সদর দপ্তর এবং ফ্লিপকার্ট, সুইগি, এবং ওলার মতো ইউনিকর্ন স্টার্টআপের কেন্দ্র। বেঙ্গালুরুর সাফল্যের পেছনে রয়েছে সরকারি নীতি, শক্তিশালী অবকাঠামো, এবং দক্ষ প্রতিভা পুল।

অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গ এখনও বেঙ্গালুরুর তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বেঙ্গালুরু ১৯৮০-এর দশকে আইটি শিল্পে প্রবেশ করেছিল, যখন উইপ্রো এবং ইনফোসিসের মতো সংস্থাগুলো শহরটিকে একটি প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। পশ্চিমবঙ্গে আইটি শিল্পের বিকাশ শুরু হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে, যখন কগনিজেন্ট এবং টিসিএসের মতো সংস্থাগুলো কলকাতায় কার্যক্রম শুরু করে। তবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ইউনিয়ন-কেন্দ্রিক নীতির কারণে অনেক বিদেশি সংস্থা বেঙ্গালুরু বা হায়দ্রাবাদের দিকে ঝুঁকেছিল।

Advertisements

চ্যালেঞ্জগুলো কী?
পশ্চিমবঙ্গের আইটি হাব হওয়ার পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  • রাজনৈতিক ইতিহাস: ১৯৭০-এর দশক থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বামফ্রন্ট সরকারের শ্রমিক ইউনিয়ন-কেন্দ্রিক নীতি এবং শিল্প বিরোধী মনোভাব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছিল। যদিও তৃণমূল কংগ্রেস সরকার এই ধারণা পরিবর্তনের চেষ্টা করছে, তবুও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা দ্বিধা রয়ে গেছে।
  • অবকাঠামোর ঘাটতি: বেঙ্গালুরুর তুলনায় কলকাতার ট্রাফিক, জল সরবরাহ, এবং শহুরে অবকাঠামো এখনও উন্নতির প্রয়োজন। নিউ টাউন এবং রাজারহাটে উন্নয়ন হলেও, এটি এখনও বেঙ্গালুরুর ইলেকট্রনিক সিটি বা মান্যতা টেক পার্কের সঙ্গে তুলনীয় নয়।
  • প্রতিভা পলায়ন: পশ্চিমবঙ্গের অনেক তরুণ প্রযুক্তি পেশাদার বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ, বা গুরুগ্রামে চাকরির জন্য চলে যাচ্ছেন। এই ‘ব্রেন ড্রেন’ রোধ করা রাজ্যের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
  • বিনিয়োগের প্রতিযোগিতা: হায়দ্রাবাদ, পুনে, এবং চেন্নাইয়ের মতো শহরগুলোও আইটি হাব হিসেবে উঠে আসছে, যা পশ্চিমবঙ্গের জন্য প্রতিযোগিতা বাড়াচ্ছে।

সাফল্যের সম্ভাবনা
পশ্চিমবঙ্গের আইটি হাব হওয়ার সম্ভাবনা বাড়াতে রাজ্য সরকারের উদ্যোগগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ‘বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি’ প্রকল্পে ৪৫টি সংস্থার মধ্যে ৪১টি ইতিমধ্যে জমি বরাদ্দের জন্য চিঠি পেয়েছে, এবং ১৯টি সংস্থা নির্মাণ শুরু করেছে। এছাড়া, রাজ্যের টিয়ার-২ শহরগুলোতে আইটি পার্কগুলো নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে। সরকারি নীতি, যেমন স্টার্টআপ ইন্ডিয়া এবং কর ছাড়, ছোট এবং মাঝারি সংস্থাগুলোকে আকর্ষণ করছে।

পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, এবং কম খরচে জীবনযাত্রার সুবিধা রাজ্যকে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য করে তুলছে। তবে, বেঙ্গালুরুর মতো একটি বিশ্বমানের আইটি হাব হতে হলে রাজ্যকে অবকাঠামো উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন, এবং প্রতিভা ধরে রাখার ক্ষেত্রে আরও কাজ করতে হবে।

পশ্চিমবঙ্গের আইটি হাব হওয়ার সম্ভাবনা অপরিসীম, তবে এটি বেঙ্গালুরুর সঙ্গে তুলনীয় হতে আরও সময় এবং প্রচেষ্টার প্রয়োজন। ‘বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি’ এবং রাজ্য সরকারের ব্যবসা-বান্ধব নীতিগুলো ইতিমধ্যে ইতিবাচক ফলাফল দেখাচ্ছে। যদি রাজ্য প্রতিভা পলায়ন রোধ করতে এবং অবকাঠামো উন্নত করতে পারে, তবে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের পরবর্তী আইটি হাব হিসেবে উঠে আসতে পারে। এটি কেবল রাজ্যের অর্থনীতিকেই শক্তিশালী করবে না, বরং ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতিতে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করবে।