ভারতে মুদ্রাস্ফীতি (Retail Inflation) গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরে খুচরা মুদ্রাস্ফীতি (রিটেল ইনফ্লেশন) ৩.৩৪ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। মন্ত্রণালয় এই সাফল্যের পিছনে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের (আরবিআই) মুদ্রানীতি এবং সরকারের খাদ্যের চাহিদা পূরণের প্রচেষ্টাকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এই সাফল্য দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং টেকসই উন্নয়নের প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রমাণ।
অর্থ মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পর এটি মুদ্রাস্ফীতির সর্বনিম্ন স্তর। ভারত কেবলমাত্র সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাই অর্জন করেনি, বরং টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। খাদ্যপণ্যের দামে হ্রাস এবং উচ্চ ভিত্তি প্রভাবের কারণে কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স (সিপিআই) ভিত্তিক খুচরা মুদ্রাস্ফীতি মার্চ মাসে ৩.৩৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি ফেব্রুয়ারি মাসে ৩.৬১ শতাংশ এবং গত বছরের মার্চ মাসে ৪.৮৫ শতাংশ ছিল। খাদ্য মুদ্রাস্ফীতির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য হ্রাস লক্ষ্য করা গেছে। ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ৩.৭৫ শতাংশ ছিল, যা মার্চে কমে ২.৬৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের মার্চ মাসে এটি ছিল ৮.৫২ শতাংশ।
আরবিআই গভর্নর সঞ্জয় মলহোত্রা গত বুধবার মুদ্রানীতি কমিটির (মনিটারি পলিসি কমিটি বা এমপিসি) সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় বলেন, মুদ্রাস্ফীতিতে ক্রমাগত হ্রাসের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। তিনি জানান, খাদ্যপণ্যের দামে কমার ফলে এই হ্রাস সম্ভব হয়েছে। তিনি আরও আশা প্রকাশ করেন যে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতি আরও কমবে, যা পরিবারগুলির উপর খরচের চাপ কমাতে সহায়ক হবে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা এবং আবহাওয়া-সম্পর্কিত বাধার কারণে মুদ্রাস্ফীতির উপর ঝুঁকি থেকে যায়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতে, আরবিআই-এর মুদ্রানীতি এবং সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সরকার জনগণের খাদ্যের চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়েছে, যা দামের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হয়েছে। আরবিআই-এর নীতিগুলি দামের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। গত সপ্তাহে আরবিআই তার প্রধান নীতিগত হার রেপো রেট ০.২৫ শতাংশ কমিয়ে ৬ শতাংশে নিয়ে এসেছে। এই পদক্ষেপ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে।
মার্চ মাসে খুচরা মুদ্রাস্ফীতির হ্রাসের পিছনে প্রধান কারণ হিসেবে শাকসবজি এবং প্রোটিনযুক্ত পণ্যের দামে কমা উল্লেখ করা হয়েছে। জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর (এনএসও) জানিয়েছে, খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি, যা সিপিআই ঝুড়ির প্রায় অর্ধেক অংশ নিয়ে গঠিত, ফেব্রুয়ারির ৩.৭৫ শতাংশের তুলনায় মার্চে কমে ২.৬৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এটি ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ৮.৫২ শতাংশ ছিল। এই হ্রাস সাধারণ মানুষের জন্য দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামে স্বস্তি এনেছে।
এছাড়াও, পাইকারি মুদ্রাস্ফীতি (হোলসেল প্রাইস ইনডেক্স বা ডব্লিউপিআই) মার্চ মাসে ছয় মাসের নিম্নতম স্তরে পৌঁছেছে। ফেব্রুয়ারিতে এটি ২.৩৮ শতাংশ ছিল, যা মার্চে কমে ২.০৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এটি শিল্প এবং ভোক্তা উভয়ের জন্যই সুখবর। অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সরকারের পদক্ষেপ এবং আরবিআই-এর সমন্বিত নীতি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
আরবিআই তার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মুদ্রাস্ফীতির পূর্বাভাস ৪ শতাংশে নির্ধারণ করেছে। প্রথম ত্রৈমাসিকে এটি ৩.৬ শতাংশ, দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ৩.৯ শতাংশ, তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ৩.৮ শতাংশ এবং চতুর্থ ত্রৈমাসিকে ৪.৪ শতাংশ থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই পূর্বাভাস ফেব্রুয়ারির সভায় অনুমান করা ৪.২ শতাংশ থেকে কিছুটা কম। আরবিআই গভর্নর মলহোত্রা জানিয়েছেন, খাদ্যের দামে অপ্রত্যাশিত হ্রাস মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়েছে। তবে, তিনি বৈশ্বিক বাজারের অনিশ্চয়তা, বিশেষ করে মার্কিন শুল্ক নীতি থেকে উদ্ভূত ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক থাকার কথা বলেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২ এপ্রিল তার “রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ” স্কিমের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি দেশের উপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করেছিলেন। ভারতকে তার সমস্ত পণ্যের উপর ২৬ শতাংশ আমদানি শুল্কের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তবে, ট্রাম্প পরবর্তীতে চীন ছাড়া অন্যান্য দেশের উপর উচ্চ শুল্ক ৯ এপ্রিল থেকে ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন। বর্তমানে ১০ শতাংশ বেস রেট এবং অটোমোবাইলের জন্য পৃথকভাবে ২৫ শতাংশ শুল্ক বহাল রয়েছে। এই বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা মুদ্রাস্ফীতির উপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে আরবিআই সতর্ক রয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, মুদ্রাস্ফীতির এই হ্রাস সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তির বিষয়। খাদ্যপণ্যের দাম কমায় দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আবহাওয়া-সম্পর্কিত সমস্যা এবং বৈশ্বিক বাজারের অস্থিরতা ভবিষ্যতে মুদ্রাস্ফীতির উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আরবিআই এবং সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এই অর্জন ভারতের অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত্তির ইঙ্গিত দেয়। সরকার এবং আরবিআই-এর নীতিগুলি কেবল মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই করেনি, বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথকে আরও মজবুত করেছে। ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে সরকারকে খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং আরবিআই-কে তার মুদ্রানীতির ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।