ভারতে ২০১৬ সালে চালু হওয়া Insolvency and Bankruptcy Code (IBC) বা দেউলিয়া ও ঋণদাতা আইনের ৯ বছর পর এক বিশাল সাফল্য উঠে এসেছে। নতুন এক রিপোর্ট অনুযায়ী, IBC-এর মাধ্যমে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে মোট ২৬ লাখ কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিষ্পত্তি হয়েছে। এই তথ্য প্রকাশ করেছে বিশিষ্ট ক্রেডিট রেটিং সংস্থা ক্রিসিল (Crisil Ratings)।
এনসিএলটি-র মাধ্যমে নিষ্পত্তি প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকার ঋণ:
ক্রিসিল জানিয়েছে, প্রায় ১২০০টির মতো কর্পোরেট দেউলিয়া মামলা National Company Law Tribunal (NCLT)-এ গিয়ে নিষ্পত্তি হয়েছে, যার আর্থিক পরিমাণ প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা। এসব হল মূলত ঋণে ডুবে যাওয়া বড় সংস্থাগুলির মামলা।
তবে, আইবিসির সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো ঋণখেলাপিদের মধ্যে যে ভয় তৈরি হয়েছে, যার ফলে প্রায় ৩০,০০০টি মামলা এনসিএলটির দরজা পর্যন্ত না গিয়েই নিষ্পত্তি হয়েছে। এসব মামলার পরিমাণ প্রায় ১৪ লাখ কোটি টাকা।
ঋণদাতাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ, সাফল্যের চাবিকাঠি:
২০১৬ সালে চালু হওয়া IBC ভারতের ঋণ পুনরুদ্ধারের নীতিতে এক বড় পরিবর্তন এনেছে। আগের তুলনায় এখন ঋণদাতাদের হাতে বেশি ক্ষমতা এসেছে। Creditor-in-control ব্যবস্থার ফলে তারা চাইলে কোম্পানির পরিচালনায় পরিবর্তন আনতে পারেন কিংবা ঋণ পুনর্গঠন করতে পারেন।
এই নমনীয়তা অনেক ছোট ও মাঝারি সংস্থার ক্ষেত্রেও কার্যকর হয়েছে। গত তিন বছরে IBC-র মাধ্যমে যতগুলি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, তার প্রায় ৬০ শতাংশই ছিল ছোট ও মাঝারি মানের, যদিও এই মামলাগুলির আর্থিক পরিমাণ ছিল মোট ঋণের মাত্র ৪০ শতাংশ।
IBC বনাম আগের ঋণ পুনরুদ্ধার পদ্ধতি:
IBC চালুর আগে ভারতের ঋণ পুনরুদ্ধারের প্রধান মাধ্যম ছিল DRT (Debt Recovery Tribunal), লোক আদালত, এবং SARFAESI আইনের মাধ্যমে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা। তবে পরিসংখ্যান বলছে, সেগুলির তুলনায় IBC অনেক বেশি কার্যকর হয়েছে:
IBC-র মাধ্যমে গড়ে ৩০-৩৫ শতাংশ পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে
SARFAESI-তে পুনরুদ্ধারের হার মাত্র ২২ শতাংশ
DRT-তে মাত্র ৭ শতাংশ
লোক আদালতে তো মাত্র ৩ শতাংশ
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
ক্রিসিল রেটিংস-এর সিনিয়র ডিরেক্টর মোহিত মাখিজা বলেন, “২০১৬ সাল থেকে যত ঋণ নিষ্পত্তি হয়েছে, তার প্রায় এক-চতুর্থাংশ এসেছে IBC-এর মাধ্যমে। এই আইন শুধুমাত্র সর্বোচ্চ পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করেছে তা নয়, মোট পুনরুদ্ধারের প্রায় অর্ধেক অংশ IBC থেকেই এসেছে।”
তিনি আরও বলেন, অবকাঠামো ও উৎপাদন খাতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ছে। ফলে, ভবিষ্যতেও ঋণদাতারা IBC-কে সর্বাধিক পছন্দের পথ হিসেবে বেছে নেবেন।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যতের রূপরেখা:
যদিও IBC অনেকাংশে সফল হয়েছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ থেকেই গেছে। যেমন অনেক মামলা দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে থাকে, প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়ে এবং আদালতের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে।
তবে কেন্দ্র সরকার এবং ইনসলভেন্সি বোর্ড বারবার IBC সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে প্রক্রিয়া দ্রুততর করা, ঋণ পুনরুদ্ধার ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী করে তোলা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামোয় ঋণ পুনরুদ্ধার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। সেখানে IBC এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। বড় সংস্থা হোক বা ছোট-মাঝারি উদ্যোগ— সবাই এখন জানে ঋণখেলাপি হলে কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। এই মনোভাবের পরিবর্তনই IBC-র আসল সাফল্য।
নতুন রিপোর্টের আলোকে এটা স্পষ্ট যে, IBC শুধু একটি আইন নয়— এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও ফেলেছে কর্পোরেট জগতে। ভবিষ্যতে এই আইনের আরও দক্ষ প্রয়োগ দেশের ঋণখেলাপি সমস্যা মোকাবিলায় বড় হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।