ভারতীয় অর্থনীতি গত এক দশকে এক অভূতপূর্ব সাফল্যের গল্প রচনা করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, গত ১০ বছরে ভারতের মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৫ সালে ভারতের জিডিপি ছিল ২.১ লক্ষ কোটি ডলার, যা ২০২৫ সালে বেড়ে ৪.৩ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ১০৫ শতাংশ, যা আমেরিকা, চিনের মতো বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতিগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। এই অসাধারণ প্রবৃদ্ধির ফলে ভারত বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে নিজের স্থান আরও মজবুত করেছে।
আমেরিকা-চিনের তুলনায় ভারতের দুর্দান্ত গতি
আইএমএফ-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে আমেরিকার জিডিপি ১৮.৩ লক্ষ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ৩০.৩ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছবে, যা ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি নির্দেশ করে। অন্যদিকে, চিনের জিডিপি ১১.১ লক্ষ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ১৯.৫ লক্ষ কোটি ডলার হবে, যা ৭৬ শতাংশ বৃদ্ধির হার দেখায়। এই দুই অর্থনৈতিক মহাশক্তির তুলনায় ভারতের ১০৫ শতাংশ বৃদ্ধি স্পষ্টতই একটি বড় অর্জন। এই তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, ভারত শুধু নিজের অর্থনীতির আকার বাড়িয়েছে তাই নয়, বরং বিশ্বের প্রধান অর্থনীতিগুলোর তুলনায় অনেক দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেছে।
অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতের অবস্থান
আইএমএফ-এর রিপোর্টে বিশ্বের অন্যান্য প্রধান অর্থনীতির তুলনাও দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানির জিডিপি ২০১৫ সালে ৩.৪ লক্ষ কোটি ডলার থেকে ২০২৫ সালে ৪.৯ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছবে, যা ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি। জাপানের জিডিপি ৪.৪ লক্ষ কোটি ডলারে স্থির থাকবে, অর্থাৎ গত ১০ বছরে কোনও বৃদ্ধি ঘটেনি। যুক্তরাজ্যের জিডিপি ২.৯ লক্ষ কোটি থেকে ৩.৭ লক্ষ কোটি ডলারে উন্নীত হবে (২৮% বৃদ্ধি), ফ্রান্সের জিডিপি ২.৪ থেকে ৩.৩ লক্ষ কোটি ডলার (৩৮% বৃদ্ধি), এবং ইটালির জিডিপি ১.৮ থেকে ২.৫ লক্ষ কোটি ডলার (৩৯% বৃদ্ধি) হবে।
এছাড়াও, কানাডার জিডিপি ১.৬ থেকে ২.৩ লক্ষ কোটি ডলার (৪৪% বৃদ্ধি), ব্রাজিলের ১.৮ থেকে ২.৩ লক্ষ কোটি ডলার (২৮% বৃদ্ধি), রাশিয়ার ১.৪ থেকে ২.২ লক্ষ কোটি ডলার (৫৭% বৃদ্ধি), দক্ষিণ কোরিয়ার ১.৫ থেকে ১.৯ লক্ষ কোটি ডলার (২৭% বৃদ্ধি), অস্ট্রেলিয়ার ১.২ থেকে ১.৯ লক্ষ কোটি ডলার (৫৮% বৃদ্ধি), এবং স্পেনের ১.২ থেকে ১.৮ লক্ষ কোটি ডলার (৫০% বৃদ্ধি) হবে। এই তথ্য থেকে স্পষ্ট যে, ভারতের বৃদ্ধির হার অন্য কোনও বড় অর্থনীতির কাছাকাছিও নেই।
এই সাফল্যের পিছনে কারণ
ভারতের এই দুর্দান্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পিছনে রয়েছে একাধিক কারণ। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’, এবং উৎপাদনভিত্তিক প্রोत্সাহন (পিএলআই) যোজনার মতো সরকারি উদ্যোগগুলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়িয়েছে। এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও, ভারতের শক্তিশালী স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম এবং তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতের অবিচ্ছিন্ন উন্নতি অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রেখেছে। সরকারের সাহসী নীতিগত সংস্কার, ব্যবসা করার সুবিধা বৃদ্ধি, এবং মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তি ভারতকে এই উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
জাপান ও জার্মানিকে পিছনে ফেলার পথে
আইএমএফ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারত চলতি বছর (২০২৫) জাপানকে অতিক্রম করে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে। জাপানের জিডিপি ৪.৪ লক্ষ কোটি ডলারে স্থির থাকলেও ভারতের জিডিপি ৪.৩ লক্ষ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়াও, ২০২৭ সালের মধ্যে ভারত জার্মানিকে পিছনে ফেলে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির স্থান দখল করবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। জার্মানির জিডিপি ২০২৫ সালে ৪.৯ লক্ষ কোটি ডলার হলেও ভারতের দ্রুত বৃদ্ধির হার এই ফারাক দ্রুত কমিয়ে আনবে।
বিশ্ব মঞ্চে ভারতের অবস্থান
এই অর্জন ভারতকে বিশ্ব অর্থনীতির একটি শক্তিশালী খুঁটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বর্তমানে ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি, যার জিডিপি ৪.৩ লক্ষ কোটি ডলার। শীর্ষ চারটি অর্থনীতি হল— আমেরিকা (৩০.৩ লক্ষ কোটি ডলার), চিন (১৯.৫ লক্ষ কোটি ডলার), জার্মানি (৪.৯ লক্ষ কোটি ডলার), এবং জাপান (৪.৪ লক্ষ কোটি ডলার)। ভারতের এই দ্রুত উত্থান বিশ্ববাসীর কাছে একটি উদাহরণ হয়ে উঠেছে যে, সঠিক নীতি ও দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে কীভাবে একটি উন্নয়নশীল দেশ বিশ্ব মঞ্চে নিজের স্থান তৈরি করতে পারে।
ভারতের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের এই বৃদ্ধির ধারা আগামী দিনেও অব্যাহত থাকবে। জনসংখ্যাগত সুবিধা, দক্ষ কর্মশক্তি, এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ভারতের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ, যেমন অবকাঠামো উন্নয়ন, নবায়নযোগ্য শক্তি, এবং স্টার্টআপ প্রকল্পগুলো ভারতকে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতিগুলোর মধ্যে আরও উপরে নিয়ে যাবে। আইএমএফ-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ভারত ২০২৫-এর জন্য ৭ শতাংশ এবং ২০২৬-এর জন্য ৬.৫ শতাংশ বৃদ্ধির হার ধরে রাখবে, যা অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।
গত এক দশকে ভারতের অর্থনৈতিক উত্থান বিশ্ববাসীকে অবাক করেছে। ১০৫ শতাংশ বৃদ্ধির হারে আমেরিকা, চিন, জাপান, জার্মানির মতো দেশগুলোকে পিছনে ফেলে ভারত প্রমাণ করেছে যে, এটি শুধু একটি উন্নয়নশীল দেশ নয়, বরং বিশ্ব অর্থনীতির একটি নতুন শক্তি। জাপানকে ২০২৫-এ এবং জার্মানিকে ২০২৭-এ অতিক্রম করার পথে থাকা ভারত আগামী দিনে আরও বড় সাফল্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। এই অর্জন ভারতের নাগরিকদের জন্য গর্বের এবং বিশ্বের জন্য একটি শিক্ষা।