আগস্ট মাসে ইউরোপে ভারতের ডিজেল রপ্তানি দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইউরোপীয় ক্রেতারা কম দামে সরবরাহ নিশ্চিত করতে আগাম কেনাকাটা শুরু করেছেন, কারণ ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল থেকে তৈরি জ্বালানি আমদানির ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হতে চলেছে।
বাজার বিশ্লেষণ সংস্থা কেপলার (Kpler)-এর তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে ভারতের ডিজেল রপ্তানি দাঁড়িয়েছে দৈনিক ২,৪২,০০০ ব্যারেলে (bpd)। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এই অঙ্ক দ্বিগুণেরও বেশি। শুধু তাই নয়, গত ১২ মাসে ভারতের ডিজেল রপ্তানির গড় বৃদ্ধির হার ১২৪ শতাংশে পৌঁছেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, একাধিক কারণে ইউরোপীয় ক্রেতাদের এই তৎপরতা। প্রথমত, নেদারল্যান্ডসের শেল কোম্পানির পারনিস রিফাইনারি হঠাৎ রক্ষণাবেক্ষণজনিত কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জোগান ব্যাহত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইউরোপের সামনে আসন্ন শীতকাল। সেই সময়ে জ্বালানির চাহিদা দ্রুত বাড়বে বলে ক্রেতারা আগাম মজুত তৈরি করতে চাইছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৮তম নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ অনুযায়ী, রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল থেকে তৈরি পরিশোধিত পণ্য, এমনকি সেগুলি অন্য দেশে প্রক্রিয়াজাত হলেও, ইউরোপে আমদানি নিষিদ্ধ। এর ফলে ভারতীয় কোম্পানি যেমন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ এবং নায়ারা এনার্জি বড় ধাক্কার মুখে পড়বে। এরা এতদিন ইউরোপে বিপুল পরিমাণে ডিজেল সরবরাহ করে আসছিল।
নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কোনও প্রকারেই ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশ করতে পারবে না। এর ফলে রাশিয়ার পাশাপাশি ভারতীয় রপ্তানিকারকরাও সমস্যায় পড়বেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি রাশিয়ান অপরিশোধিত তেলের দামসীমা কমিয়ে প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলার থেকে ৪৭.৬ ডলারে নামিয়েছে। একইসঙ্গে নতুন একটি স্বয়ংক্রিয় ও গতিশীল ব্যবস্থা চালু হয়েছে, যাতে প্রতি ছয় মাসে বাজারমূল্যের তুলনায় সর্বদা ১৫ শতাংশ কম দামে রাশিয়ান তেল বিক্রি হয়। এই প্রক্রিয়ার ফলে ইউরোপীয় অপারেটররা স্পষ্ট পূর্বাভাস পাবেন এবং রাশিয়ার জ্বালানি আয়ে চাপ বাড়বে।
ইউরোপ রাশিয়ার তথাকথিত “শ্যাডো ফ্লিট”-এর একাধিক জাহাজকেও তালিকাভুক্ত করেছে। এই বহরে এমন সব ট্যাঙ্কার রয়েছে, যা রাশিয়ার জ্বালানি গোপনে পরিবহনে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে তিনটি এলএনজি ট্যাঙ্কারও রয়েছে, যেগুলি ইউরোপীয় প্রতিশ্রুতির পর তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে যে তারা আর রাশিয়ার জ্বালানি বহনে অংশ নেবে না।
এদিকে শুক্রবার আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমেছে। বেঞ্চমার্ক ব্রেন্ট ক্রুডের দাম কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি ব্যারেল ৬৬.৮০ ডলারে। মার্কিন ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (WTI) ক্রুড ০.৩৬ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৬৩.২৫ ডলারে।
তেলের দামে এই পতনের পেছনে দুটি প্রধান কারণ রয়েছে—
1. ওপেক+ গোষ্ঠী উৎপাদন বাড়াতে পারে বলে বাজারে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।
2. যুক্তরাষ্ট্রে অপরিশোধিত তেলের মজুত বেড়েছে।
এই দুই কারণে ক্রেতারা সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন এবং দামে নিম্নমুখী চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
ভারতের ডিজেল রপ্তানি আপাতত রেকর্ড উচ্চতায় থাকলেও ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে রপ্তানির প্রবাহে বাধা আসবে। বর্তমানে ভারত মূলত রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল আমদানি করে তা রিফাইন করে ইউরোপে রপ্তানি করছে। ইউরোপের নতুন নিয়ম সেই পথ বন্ধ করে দেবে।
শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতীয় রপ্তানিকারকদের নতুন বাজার খুঁজতে হবে, বিশেষ করে আফ্রিকা, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে। তবে ইউরোপীয় বাজার হারানো ভারতের পরিশোধন শিল্পের জন্য বড় ক্ষতি হবে।
আগস্টে ভারতের ডিজেল রপ্তানি ইউরোপে দ্বিগুণ হওয়া নিঃসন্দেহে একটি বড় সাফল্য। কিন্তু সামনের পথ এতটা সহজ নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাশিয়া-নিষেধাজ্ঞা, নতুন দামের সীমা, এবং আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা মিলিয়ে ভারতীয় জ্বালানি রপ্তানিকারকদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তবুও, বর্তমানের রপ্তানি বৃদ্ধি ভারতের জ্বালানি কূটনীতিতে এক শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে, যা বিশ্ববাজারে ভারতের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।