গত কয়েক বছরে ভারতে ক্রেডিট কার্ড (Credit Card) ব্যবহারের হার দ্রুতগতিতে বেড়েছে। ডিজিটাল পেমেন্টের প্রসার এবং ভোক্তাভিত্তিক ব্যয়ের বৃদ্ধি এই খাতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তবে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (RBI)-র সাম্প্রতিক তথ্য এক নতুন উদ্বেগের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ক্রেডিট কার্ড ঋণের ক্ষেত্রে সম্পদ গুণগত মান বা ‘অ্যাসেট কোয়ালিটি’-র অবনতি ঘটছে, যা দেশের আর্থিক খাতের জন্য এক গুরুতর বার্তা বহন করে।
RBI-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে ক্রেডিট কার্ড ঋণখেলাপির (Non-Performing Assets বা NPA) পরিমাণ ২৮.৪২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬,৭৪২ কোটি টাকায়। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এই পরিমাণ ছিল ৫,২৫০ কোটি, অর্থাৎ এক বছরে প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকার বৃদ্ধি ঘটেছে।
এই বৃদ্ধি আরও উদ্বেগের কারণ, কারণ বর্তমানে মোট ক্রেডিট কার্ড ঋণের ২.৩ শতাংশ NPA হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা ২০২৩ সালে ছিল ২.০৬ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ক্রেডিট কার্ড ঋণের পরিমাণ ছিল ২.৯২ লক্ষ কোটি টাকা, যেখানে এক বছর আগে তা ছিল ২.৫৩ লক্ষ কোটি।
এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বাড়লেও সময়মতো ঋণ পরিশোধে অসচেতনতা ও অক্ষমতা বাড়ছে, যার ফলে সামগ্রিক আর্থিক ঝুঁকি বাড়ছে। এই অবস্থার পেছনে একাধিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ কাজ করছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
একটি RTI বা তথ্যের অধিকার আইনের অধীনে দায়ের করা প্রশ্নের উত্তরে প্রকাশ, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ক্রেডিট কার্ড NPA-এর পরিমাণ ছিল মাত্র ১,১০৮ কোটি, যা ২০২৪ সালের মধ্যে ৫০০ শতাংশের বেশি বেড়ে গিয়েছে। এই পরিসংখ্যান আগামী দিনে আর্থিক খাতে বড় বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
জাভো (Zavo) নামক ঋণ পরিশোধ প্ল্যাটফর্মের প্রতিষ্ঠাতা কুন্দন শাহি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘ভারতের ক্রেডিট কার্ড ঋণ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছে, যার পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, আক্রমণাত্মক ঋণদানের কৌশল, এবং আর্থিক সচেতনতার অভাব।’’
বিশেষ করে গিগ ওয়ার্কার এবং ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ীদের (MSME) অনিয়মিত আয়ের কারণে তারা প্রায়ই নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচের জন্যও ক্রেডিট কার্ডের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন। ২০২৩ সালে ৮ মিলিয়নেরও বেশি বেতনের চাকরি হারানোর ফলে বহু মানুষের আয় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, যার প্রভাব ২০২৪ সালেও দেখা গেছে।
অন্যদিকে, FY24 অর্থাৎ ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে ব্যাংকগুলি ১০ কোটি ২০ লক্ষের বেশি নতুন ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করেছে। এই নতুন কার্ড অনেক ক্ষেত্রেই নিম্নআয়ের গ্রাহক কিংবা প্রথমবারের ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে, যাঁদের ঋণ পরিশোধ ক্ষমতা নিয়ে আগাম কোনো বিশ্লেষণ করা হয়নি।
এই সহজলভ্যতার ফলে বহু মানুষ পরিকল্পনা ছাড়াই খরচ করছেন এবং ধীরে ধীরে ঋণের ফাঁদে পড়ছেন। কুন্দন শাহির মতে, এই অবস্থা ‘ডেট ট্র্যাপ’-এর মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন।
আর্থিক অশিক্ষাও এই সংকটের বড় কারণ। অনেক গ্রাহক জানেন না যে বিল সময়মতো পরিশোধ না করলে কতটা ভারী সুদ দিতে হতে পারে, কিংবা তাদের ক্রেডিট স্কোর কীভাবে প্রভাবিত হতে পারে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, যাঁরা প্রায়ই অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন, তারা এই ফাঁদে বেশি পড়ছেন। UPI এবং রূপে কার্ডের সংযুক্তিকরণে ডিজিটাল খরচ আরও সহজ হয়েছে, তবে সেইসঙ্গে ব্যয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন বহু ব্যবহারকারী।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এই খাতে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ না আনলে আগামী দিনে বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। ক্রেডিট কার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে আরও কড়া যাচাই, আর্থিক শিক্ষার প্রসার এবং গ্রাহকদের দায়িত্বশীল ব্যবহারে উৎসাহিত করাই এখন একান্ত প্রয়োজন।
ভারতের ক্রমবর্ধমান ক্রেডিট কার্ড বাজার একদিকে যেমন আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে ত্বরান্বিত করছে, অন্যদিকে এটি যদি নজরদারি ছাড়া চলতে থাকে, তবে ঋণখেলাপি ও ঋণফাঁদ সমস্যা এক ভয়ানক সামাজিক সংকটে পরিণত হতে পারে। সুতরাং, ব্যাংক, সরকার এবং ভোক্তাদের একযোগে সচেতন হওয়া ছাড়া এই সমস্যার মোকাবিলা সম্ভব নয়।