মধ্যবিত্তের স্বপ্নভঙ্গ! বেতনভিত্তিক চাকরির যুগ কি শেষের পথে?

ভারতের মধ্যবিত্ত (Indian Middle Class) শ্রেণির গল্প কি শেষের পথে? মার্সেলাস ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজার্সের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাজার বিশেষজ্ঞ সৌরভ মুখার্জি এমনটাই মনে করছেন। তাঁর মতে, ভারত…

Indian Middle Class at Risk? Expert Warns of Job Market Disruption

ভারতের মধ্যবিত্ত (Indian Middle Class) শ্রেণির গল্প কি শেষের পথে? মার্সেলাস ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজার্সের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাজার বিশেষজ্ঞ সৌরভ মুখার্জি এমনটাই মনে করছেন। তাঁর মতে, ভারত এই দশকে একটি নতুন অর্থনৈতিক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে, যেখানে “বেতনভিত্তিক চাকরি একটি লাভজনক পথ হিসেবে” ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সম্প্রতি একটি পডকাস্টে, যার নাম বিয়ন্ড দ্য পেচেক: ইন্ডিয়াস এন্ট্রেপ্রেনিউরিয়াল রিবার্থ, মুখার্জি বলেন, “এই দশকের সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য হবে বেতনভিত্তিক চাকরির মৃত্যু। শিক্ষিত, দৃঢ়সংকল্প এবং পরিশ্রমী মানুষের জন্য বেতনভিত্তিক চাকরি আর লাভজনক পথ হিসেবে টিকে থাকবে না।”

Advertisements

তিনি আরও বলেন, “আমাদের পিতামাতারা যে পুরনো মডেলে একটি সংস্থায় ৩০ বছর কাজ করেছেন, সেই মডেল এখন মৃতপ্রায়। ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠার জন্য যে চাকরির কাঠামো ছিল, তা আর টেকসই নয়।”

   

অটোমেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব

মুখার্জির মতে, পরিশ্রমী মানুষের কাজ ক্রমশ অটোমেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। তিনি বলেন, “হোয়াইট-কলার কর্মীদের যে কাজগুলো করার কথা ছিল, তার বেশিরভাগই এখন এআই দিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে। গুগল জানিয়েছে, তাদের কোডিংয়ের এক-তৃতীয়াংশ ইতিমধ্যে এআই দ্বারা করা হচ্ছে। ভারতীয় আইটি, মিডিয়া এবং ফিনান্স খাতেও একই ধরনের পরিবর্তন আসছে।”

তিনি আরও উল্লেখ করেন যে মধ্য-স্তরের ক্যারিয়ার বিকল্পগুলো এখন প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির কারণে অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। এই পরিবর্তন শুধুমাত্র ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্যই নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

উদ্যোক্তা হিসেবে ভবিষ্যৎ

এই অন্ধকার দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও, মুখার্জি ভারত সরকারের সাম্প্রতিক কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেন, জনধন, আধার এবং মোবাইলের সমন্বয়ে গঠিত ‘জ্যাম ট্রিনিটি’ উদ্যোক্তাদের একটি নতুন তরঙ্গের জন্য মঞ্চ তৈরি করতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার জ্যাম ট্রিনিটি সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য উল্লেখযোগ্য সম্পদ বিনিয়োগ করেছে, যার লক্ষ্য নিম্ন-আয়ের গোষ্ঠীগুলোর জন্য পরিচয়, ব্যাঙ্কিং এবং তথ্য পণ্যের সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।

মুখার্জি বলেন, “যদি আমরা কর্পোরেট ক্যারিয়ারে যে বুদ্ধিমত্তা এবং কঠোর পরিশ্রম প্রয়োগ করেছি, তা যদি উদ্যোক্তা হিসেবে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারে সমৃদ্ধির নতুন ইঞ্জিন।” তিনি আরও পরামর্শ দেন যে ভারতীয় সমাজের স্থিতিশীলতা এবং বেতনের সঙ্গে যুক্ত দর্শন পরিবর্তন করা প্রয়োজন।

“আমরা একটি অর্থকেন্দ্রিক সমাজ। আমরা সাফল্যকে বেতনের চেক দিয়ে মাপি। এই ধারণা পরিবর্তন করতে হবে,” তিনি বলেন। “আমাদের সুখ এবং প্রভাবের জন্য সমাধান খুঁজতে হবে, শুধু মাসিক আয়ের জন্য নয়।”

Advertisements

সমাজের মানসিকতায় পরিবর্তনের প্রয়োজন

মুখার্জি আরও জোর দিয়ে বলেন, “আপনার এবং আমার মতো পরিবারগুলোকে তাদের সন্তানদের চাকরি-প্রার্থী হিসেবে প্রস্তুত করা বন্ধ করতে হবে। কারণ, সেই চাকরিগুলো আর থাকবে না।” তিনি মনে করেন, ভারতীয় সমাজকে এখন থেকেই তরুণ প্রজন্মকে উদ্যোক্তা মানসিকতার সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে। এটি কেবল ব্যক্তিগত সাফল্যের জন্য নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্যও অপরিহার্য।

তিনি বলেন, ভারতের তরুণদের এখন এমন একটি পরিবেশে প্রস্তুত করতে হবে, যেখানে তারা নিজেদের ব্যবসা শুরু করতে পারে, নতুন ধারণা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারে এবং প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় সরকারের ডিজিটাল অবকাঠামো এবং জ্যাম ট্রিনিটির মতো উদ্যোগগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

ভারতীয় অর্থনীতির ভবিষ্যৎ

মুখার্জির এই ভবিষ্যদ্বাণী ভারতীয় অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ভারতের অর্থনীতি এখন একটি রূপান্তরের মুখে দাঁড়িয়ে। যেখানে একদিকে প্রযুক্তির অগ্রগতি ঐতিহ্যবাহী চাকরির কাঠামোকে ভেঙে দিচ্ছে, সেখানে নতুন সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে। উদ্যোক্তা হিসেবে ভারতীয় তরুণদের উত্থান দেশের অর্থনীতিকে নতুন দিশা দিতে পারে।

তবে, এই রূপান্তর সহজ হবে না। সমাজের মানসিকতা পরিবর্তন, শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার এবং উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা এই প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এই দায়িত্ব নিতে হবে।

সৌরভ মুখার্জির এই বিশ্লেষণ ভারতীয় সমাজ এবং অর্থনীতির জন্য একটি সতর্কবার্তা। বেতনভিত্তিক চাকরির উপর নির্ভরশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। তবে, তিনি আশাবাদী যে উদ্যোক্তা হিসেবে ভারতীয় তরুণদের উত্থান এই সংকটকে সুযোগে রূপান্তর করতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, ভারতীয় সমাজ কি এই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত? সময়ই বলবে, কিন্তু এই রূপান্তরের জন্য এখন থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।