ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলির ঋণ (Indian Bank Loan) বৃদ্ধি ফেব্রুয়ারি মাসে টানা আট মাস ধরে মন্দা হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের তথ্যে প্রকাশ পেয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (RBI)-এর তথ্য অনুযায়ী, ব্যক্তিগত ঋণ এবং ক্রেডিট কার্ড ঋণে হ্রাসের কারণে এই মন্দা দেখা দিয়েছে, যা আরবিআই-এর কঠোর নিয়মের ফলাফল।
তথ্য অনুসারে, গত মাসে ব্যাঙ্কগুলির ঋণ বৃদ্ধি বছরে ১২% হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে ১৬.৬% বৃদ্ধির তুলনায় কম। এই হিসাবে এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক এবং তার মূল সংস্থা হাউজিং ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (এইচডিএফসি)-এর একীভূতকরণের প্রভাব বাদ দেওয়া হয়েছে। একীভূতকরণের প্রভাবসহ, ফেব্রুয়ারিতে ঋণ বৃদ্ধি হয়েছে ১১%, যেখানে গত বছর এই সময়ে এটি ছিল ২০.৫%। জানুয়ারিতে ঋণ বৃদ্ধির হার ছিল ১২.৫% (একীভূতকরণ বাদে) এবং ১১.৪% (একীভূতকরণসহ)।
ভারতের ব্যাঙ্কিং খাতে পরিবর্তন-Indian Bank Loan
ভারতের ব্যাঙ্কিং খাত গত কয়েক বছর ধরে দ্রুত ঋণ বৃদ্ধির সাক্ষী হয়েছে, যা মূলত খুচরা চাহিদা এবং অসুরক্ষিত ঋণের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের শেষের দিকে, আরবিআই ব্যক্তিগত ঋণ, ক্রেডিট কার্ড ঋণ এবং নন-ব্যাঙ্কিং ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানি (এনবিএফসি)-তে ঋণের উপর কঠোর মূলধন প্রয়োজনীয়তা আরোপ করে হস্তক্ষেপ করে। সম্ভাব্য খারাপ ঋণ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে, আরবিআই-এর কঠোর ঋণ নীতি ঝুঁকি কমানোর লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয়েছিল। একই সঙ্গে, ব্যাঙ্কগুলি তাদের ঋণ-জমা অনুপাত (একটি গুরুত্বপূর্ণ তরলতা মেট্রিক) অপ্টিমাইজ করতে ঋণ প্রদান কমিয়েছে, যখন জমা সংগ্রহের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা চলছিল।
এর ফলে গত কয়েক মাস ধরে ঋণ বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে মন্দ হয়েছে, বিশেষ করে ব্যক্তিগত এবং ক্রেডিট কার্ড ঋণে এর প্রভাব স্পষ্ট। তবে গত মাসে আরবিআই তার মূলধন প্রয়োজনীয়তা নিয়ম শিথিল করেছে, যা ডিসেম্বরে সঞ্জয় মালহোত্রা গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই পরিবর্তন অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তবে এর ফলাফল কয়েক মাস পরেই দৃশ্যমান হবে।
ব্যক্তিগত ঋণ ও ক্রেডিট কার্ডে প্রভাব
তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে ব্যক্তিগত ঋণের বৃদ্ধি বছরে ৮.৪%-এ নেমে এসেছে, যা গত বছরের ১৯.৫% থেকে অর্ধেকেরও বেশি কম। এই হিসাবে এইচডিএফসি ব্যাঙ্কের একীভূতকরণের প্রভাব বাদ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে, ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া ঋণের বৃদ্ধি ৩১% থেকে কমে ১১.২%-এ দাঁড়িয়েছে। এই হ্রাস আরবিআই-এর নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ এবং ব্যাঙ্কগুলির ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার প্রতিফলন।
সেবা খাতে ঋণ বৃদ্ধি ফেব্রুয়ারিতে ১৩%-এ নেমেছে, যা গত বছরের ২১.৪% থেকে অনেক কম। এর প্রধান কারণ এনবিএফসি-তে ঋণ প্রদানে হ্রাস। অন্যদিকে, শিল্প খাতে ঋণ গত মাসে ৭.৩% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গত বছরের ৮.৪% থেকে কিছুটা কম।
কেন এই মন্দা?
ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলি দীর্ঘদিন ধরে খুচরা চাহিদা এবং অসুরক্ষিত ঋণের উপর ভর করে দ্বিগুণ হারে ঋণ বৃদ্ধি করে এসেছে। কিন্তু ২০২৩-এর শেষে আরবিআই-এর হস্তক্ষেপ এই প্রবণতায় পরিবর্তন এনেছে। ব্যক্তিগত ঋণ এবং ক্রেডিট কার্ড ঋণে অতিরিক্ত ঝুঁকির আশঙ্কায় আরবিআই ব্যাঙ্কগুলির উপর কঠোর মূলধন প্রয়োজনীয়তা আরোপ করে। এর পাশাপাশি, ব্যাঙ্কগুলি তাদের ঋণ-জমা অনুপাত সামঞ্জস্য করতে ঋণ প্রদানে সতর্কতা অবলম্বন করেছে। জমা সংগ্রহে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির মধ্যে ব্যাঙ্কগুলি তরলতা বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছে, যা ঋণ বৃদ্ধির গতি কমিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত ঋণ এবং ক্রেডিট কার্ড ঋণে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে। গত বছরের তুলনায় এই খাতে বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। তবে শিল্প খাতে ঋণ বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে, যদিও এটিও গত বছরের তুলনায় কিছুটা কম।
আরবিআই-এর নতুন পদক্ষেপ
গত মাসে আরবিআই মূলধন প্রয়োজনীয়তা নিয়ম শিথিল করেছে, যা নতুন গভর্নর সঞ্জয় মালহোত্রার নেতৃত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ২০২৩-এর কঠোর নীতির পর এই শিথিলকরণ অর্থনীতিতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ব্যাঙ্কগুলির ঋণ প্রদান ক্ষমতা বাড়াবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তবে এর প্রভাব দেখতে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।
খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ
ব্যক্তিগত ঋণ: ফেব্রুয়ারিতে ব্যক্তিগত ঋণের বৃদ্ধি ৮.৪%-এ নেমেছে, যা গত বছরের ১৯.৫% থেকে অনেক কম। এটি আরবিআই-এর কঠোর নিয়ম এবং ব্যাঙ্কগুলির সতর্কতার ফল।
ক্রেডিট কার্ড: ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া ঋণের বৃদ্ধি ১১.২%-এ নেমেছে, যা গত বছর ছিল ৩১%। এটি খুচরা ঋণে চাহিদা কমার ইঙ্গিত দেয়।
সেবা খাত: সেবা খাতে ঋণ বৃদ্ধি ১৩%-এ নেমেছে, যা এনবিএফসি-তে ঋণ কমার কারণে ঘটেছে।
শিল্প খাত: শিল্পে ঋণ বৃদ্ধি ৭.৩%, যা গত বছরের ৮.৪% থেকে সামান্য কম।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
আরবিআই-এর সাম্প্রতিক নিয়ম শিথিলকরণ ব্যাঙ্কগুলির জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি ঋণ বৃদ্ধির গতি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে, বিশেষ করে ব্যক্তিগত এবং ক্রেডিট কার্ড ঋণে। তবে এই পরিবর্তনের ফলাফল দৃশ্যমান হতে সময় লাগবে। এদিকে, ব্যাঙ্কগুলি জমা সংগ্রহে মনোযোগ বাড়িয়েছে, যা তাদের তরলতা পরিস্থিতি উন্নত করতে পারে।
ভারতীয় ব্যাঙ্কিং খাতে ঋণ বৃদ্ধির এই মন্দা আরবিআই-এর নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ এবং ব্যাঙ্কগুলির সতর্কতার সম্মিলিত ফল। যদিও ব্যক্তিগত এবং ক্রেডিট কার্ড ঋণে বড় ধরনের হ্রাস দেখা গেছে, শিল্প খাতে ঋণ বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে। আরবিআই-এর সাম্প্রতিক শিথিলকরণ ভবিষ্যতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে পারে, তবে এর প্রভাব এখনও অনিশ্চিত। এই পরিস্থিতি ভারতীয় অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়, যা ব্যাঙ্কিং খাতের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করবে।