ভারত-UK চুক্তিতে রপ্তানি শিল্পে উচ্ছ্বাস, পেশাজীবীদের জন্য সুখবর

ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) স্বাক্ষরিত হতে চলেছে বৃহস্পতিবার। বহুপ্রতীক্ষিত এই চুক্তি উভয় দেশের জন্যই আর্থিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে…

ভারত-UK চুক্তিতে রপ্তানি শিল্পে উচ্ছ্বাস, পেশাজীবীদের জন্য সুখবর

ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) স্বাক্ষরিত হতে চলেছে বৃহস্পতিবার। বহুপ্রতীক্ষিত এই চুক্তি উভয় দেশের জন্যই আর্থিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিলিয়ন ডলারের নতুন সুযোগ এনে দিতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চতুর্থ যুক্তরাজ্য সফরের প্রাক্কালে এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।

মোদি-স্টারমার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক
এই সফরে প্রধানমন্ত্রী মোদি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করবেন। চুক্তি স্বাক্ষরের পরে তিনি মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন।

   

এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিটি দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার ফসল। আলোচনার সূচনা হয়েছিল জানুয়ারি ২০২২ সালে, বরিস জনসনের প্রধানমন্ত্রীত্বে। তখন লক্ষ্য ছিল দীপাবলির আগেই এটি চূড়ান্ত করা। তবে নানা জটিলতা ও বিলম্ব কাটিয়ে মে ২০২৫-এ এসে অবশেষে চুক্তিটি চূড়ান্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদি একে “ঐতিহাসিক অর্জন” বলে অভিহিত করেছেন।

ভারতের লাভ কোথায়?
এই FTA-এর ফলে ভারতের জন্য যুক্তরাজ্যে রপ্তানির এক বিশাল সুযোগ তৈরি হবে, বিশেষত হস্তশিল্প ও শ্রমনির্ভর শিল্পখাতে। রপ্তানিতে বিশেষ সুবিধা পাবে রত্ন ও গহনা, টেক্সটাইল, সামুদ্রিক পণ্য, চামড়া, জুতো, খেলাধুলার সামগ্রী ও খেলনা। এছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, গাড়ির যন্ত্রাংশ, জৈব রাসায়নিক ইত্যাদির ক্ষেত্রেও রপ্তানি বাড়বে।

অবাঞ্ছিত বাধা রোধে সতর্কতা
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রক এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, চুক্তিতে এমনভাবে শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে যাতে কোনও অনাবশ্যক নন-ট্যারিফ বাধা ভারতের রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে।

রত্ন ও গহনা খাতে উল্লম্ফন
Gem & Jewellery Export Promotion Council (GJEPC) জানিয়েছে, চুক্তির ফলে যুক্তরাজ্যে ভারতের রত্ন ও গহনার বাজার বাড়বে। বর্তমানে যুক্তরাজ্য প্রতি বছর প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের গহনা আমদানি করে, যার মধ্যে ভারতের অংশ মাত্র ৪০০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১৫%)। এই চুক্তি সেই অংশবিশেষকে বহুগুণে বাড়াতে সাহায্য করবে।

আইটি ও পেশাজীবীদের জন্য বড় সুযোগ
চুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ভারতীয় পেশাজীবীদের জন্য ভিসা ও কাজের নিয়ম শিথিল করা। এর ফলে প্রতিবছর ৬০,০০০-এরও বেশি আইটি পেশাদার উপকৃত হবেন বলে বাণিজ্য মন্ত্রক আশা করছে। উপকৃত সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে—TCS, Infosys, Tech Mahindra, HCL Technologies ও Wipro।

চা, মশলা ও প্রস্তুত খাবারের রপ্তানি বাড়বে
চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় চা, মশলা এবং রেডি-টু-ইট খাবারের ওপর ট্যারিফ ছাড় দেওয়া হবে। ফলে যুক্তরাজ্যে এই পণ্যের বাজার আরও বিস্তৃত হবে।

সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা
ভারতীয় কর্মীরা যুক্তরাজ্যে কাজ করলে এখন তিন বছর পর্যন্ত ব্রিটিশ সামাজিক নিরাপত্তা তহবিলে টাকা দিতে হবে না। এতে বছরে প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকার সাশ্রয় হবে।

Advertisements

সংস্কৃতি ও পরিষেবা খাতে প্রবেশাধিকার
এই চুক্তি ভারতীয় রন্ধনশিল্পী, যোগ শিক্ষক, সঙ্গীতশিল্পী ও অন্যান্য চুক্তিভিত্তিক পেশাজীবীদের জন্যও সুযোগ খুলে দিচ্ছে। তারা অস্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যে কাজ করতে পারবেন, যা ভারতের পরিষেবা শিল্পে বড় অনুঘটকের কাজ করবে।

যুক্তরাজ্যের লাভ কোথায়?
চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাজ্য ভারতীয় আমদানি শুল্কে উল্লেখযোগ্য ছাড় পাচ্ছে। ব্রিটিশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ৯০% ট্যারিফ লাইনের ওপর ছাড় মিলবে, যার মধ্যে ৮৫% পণ্য আগামী ১০ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত হবে।

হুইস্কি ও জিনের ওপর শুল্ক হ্রাস
ভারতে হুইস্কি ও জিনের আমদানিতে শুল্ক ১৫০% থেকে কমে প্রথমে ৭৫% এবং পরে ৪০%-এ নামিয়ে আনা হবে দশ বছরের মধ্যে।

গাড়ি আমদানিতে ছাড়
ব্রিটিশ গাড়ির ওপর আমদানি শুল্ক ১০% পর্যন্ত কমানো হবে, তবে তা নির্ধারিত পরিমাণের (quota) মধ্যে থাকবে।

বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক ছাড়
চুক্তিতে আরও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—চকোলেট, কসমেটিক্স, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, সফট ড্রিংকস, ল্যাম্ব মাংস, স্যালমন মাছ ও ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রের ওপর শুল্ক হ্রাস।

সরকারি টেন্ডারে অংশগ্রহণের সুযোগ
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সুবিধা হল, যুক্তরাজ্যের কোম্পানিগুলো এখন থেকে ভারতের সরকার পরিচালিত নন-সংবেদনশীল প্রকল্পে (₹২০০ কোটি টাকার উপরে) টেন্ডারে অংশ নিতে পারবে। বছরে প্রায় ৪০,০০০টি টেন্ডার, যার সম্মিলিত মূল্য ₹৪.০৯ লাখ কোটি—সেগুলোতে এখন থেকে ব্রিটিশ সংস্থাগুলো দরপত্র জমা দিতে পারবে।

ভারত-যুক্তরাজ্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি শুধু দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে দৃঢ় করবে না, বরং কর্মসংস্থান, রপ্তানি ও প্রযুক্তি খাতে বহুমাত্রিক সুযোগ সৃষ্টি করবে। বহু বছরের আলোচনার সফল পরিণতি হিসেবে এই FTA ভারত-ব্রিটেন সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায় সূচিত করল। এখন দেখার, এই চুক্তির বাস্তবায়ন কতটা দ্রুত ও কার্যকরভাবে হয়।