সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ‍‍‘সবুজ শিপিং’ ও ডিজিটাল ব্যবসার পথ খুঁজছে ভারত

সিঙ্গাপুর, ১৯ মার্চ ২০২৫: ভারতের সবুজ জ্বালানি এবং ডিজিটাল উদ্যোগ এখন সিঙ্গাপুরের (Singapore) সমুদ্র ও শিপিং শিল্পের (Green shipping) মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যে প্রবেশ করতে চলেছে।…

Green shipping India Singapore

সিঙ্গাপুর, ১৯ মার্চ ২০২৫: ভারতের সবুজ জ্বালানি এবং ডিজিটাল উদ্যোগ এখন সিঙ্গাপুরের (Singapore) সমুদ্র ও শিপিং শিল্পের (Green shipping) মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যে প্রবেশ করতে চলেছে। সিঙ্গাপুর বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শিপিং হাব হিসেবে পরিচিত, যেখানে প্রতি বছর ৫৫ মিলিয়ন টনেরও বেশি বাঙ্কার জ্বালানি আন্তর্জাতিকভাবে চলমান জাহাজগুলোতে সরবরাহ করা হয়। বাণিজ্য সূত্রে জানা গেছে, ভারত এবং সিঙ্গাপুর যৌথভাবে “গ্রিন ডিজিটাল শিপিং করিডর” নিয়ে আলোচনা করছে, যা অন্যান্য আন্তর্জাতিক বন্দর এবং সমুদ্র শিল্পের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে।

বুধবার পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন, ভারতের সবুজ জ্বালানি, সবুজ হাইড্রোজেন এবং অ্যামোনিয়া রপ্তানির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সিঙ্গাপুরের কৌশলগত অবস্থানের সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই। সিঙ্গাপুরের শিপিং ইকোসিস্টেমের মাধ্যমে এই জ্বালানিগুলো বিশ্বব্যাপী চলমান জাহাজগুলোর জন্য বাজারজাত করা সম্ভব হবে। এই উদ্যোগ ভারতের পরিবেশবান্ধব শক্তির লক্ষ্য এবং সিঙ্গাপুরের ডিজিটাল ও শিপিং দক্ষতাকে একত্রিত করে একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে।

   

গ্রিন ডিজিটাল শিপিং করিডর: একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ
“গ্রিন ডিজিটাল শিপিং করিডর” ভারতীয় সমুদ্র শিল্পকে বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করার একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। এই করিডরের মাধ্যমে ভারত তার সবুজ জ্বালানি রপ্তানির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারবে, এবং সিঙ্গাপুর এই জ্বালানিগুলোকে আন্তর্জাতিক শিপিং শিল্পে ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করবে। সিঙ্গাপুরের মেরিটাইম অ্যান্ড পোর্ট অথরিটি (এমপিএ) এই প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এই উদ্যোগের আলোচনা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে এবং শিগগিরই একটি ‘লেটার অফ ইনটেন্ট’ (এলওআই) স্বাক্ষরিত হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই করিডর শুধু সবুজ জ্বালানি রপ্তানির পথই খুলবে না, বরং ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে শিপিং প্রক্রিয়াকে আরও দক্ষ ও পরিবেশবান্ধব করে তুলবে। সিঙ্গাপুরের ডিজিটাল দক্ষতা এবং ভারতের নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন ক্ষমতা এই সহযোগিতার মূল শক্তি।

ভারতের সবুজ জ্বালানি উচ্চাকাঙ্ক্ষা
ভারত সরকার সবুজ হাইড্রোজেন এবং অ্যামোনিয়াকে বিশ্ব বাজারে রপ্তানির জন্য বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছেন যে, ভারতকে সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদন, ব্যবহার এবং রপ্তানির একটি বিশ্ব কেন্দ্রে পরিণত করা হবে। জাতীয় গ্রিন হাইড্রোজেন মিশনের অধীনে, ভারত নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে এই জ্বালানিগুলো উৎপাদন করছে। তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনে সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক সেম্বকর্প ইন্ডাস্ট্রিজ ৩৬,২৩৮ কোটি টাকা বিনিয়োগে একটি সবুজ অ্যামোনিয়া প্ল্যান্ট স্থাপন করছে, যা প্রতি বছর ২,০০,০০০ মেট্রিক টন উৎপাদন করবে। এই অ্যামোনিয়া জাপানে রপ্তানি করা হবে, এবং সিঙ্গাপুর এই প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে।

এছাড়াও, ওড়িশায় সেম্বকর্প একটি ৭,২০,০০০ মেট্রিক টন ক্ষমতার সবুজ হাইড্রোজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে। এই প্রকল্পগুলো ভারতের সৌরশক্তি এবং বায়ুশক্তির প্রাচুর্যকে কাজে লাগিয়ে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উৎপাদন করবে। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সহযোগিতা এই জ্বালানিগুলোকে বিশ্বব্যাপী শিপিং শিল্পে পৌঁছে দেওয়ার পথ সুগম করবে।

সিঙ্গাপুরের কৌশলগত গুরুত্ব
সিঙ্গাপুর বিশ্বের বৃহত্তম শিপিং এবং মেরিন ট্রেড হাবগুলোর মধ্যে একটি। এখানে প্রতি বছর লাখ লাখ জাহাজ জ্বালানি সংগ্রহ করে। সিঙ্গাপুরের পোর্ট অথরিটি ইতিমধ্যেই সবুজ জ্বালানি যেমন অ্যামোনিয়া এবং হাইড্রোজেনকে শিপিং জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে। ২০২৪ সালে, সিঙ্গাপুরে বিশ্বের প্রথম অ্যামোনিয়া-চালিত জাহাজের জন্য জ্বালানি সরবরাহ করা হয়েছিল, যা শিপিং শিল্পের কার্বন নিঃসরণ কমানোর একটি বড় পদক্ষেপ।

ভারতের সবুজ জ্বালানি এই শিপিং হাবের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে, উভয় দেশই পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক সুবিধা পাবে। সিঙ্গাপুরের ডিজিটাল প্রযুক্তি এই প্রক্রিয়ায় শিপিং ব্যবস্থাপনাকে আরও সুগম এবং দক্ষ করে তুলবে, যেমন জাহাজের রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং, জ্বালানি সরবরাহের সমন্বয় এবং বন্দরে লেনদেনের স্বচ্ছতা।

দুই দেশের সহযোগিতার সম্ভাবনা
ভারত এবং সিঙ্গাপুরের মধ্যে এই সহযোগিতা শুধু জ্বালানি রপ্তানির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গড়করি সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রপতি থারমান শানমুগারত্নমের সঙ্গে সবুজ হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া এবং টেকসই বিমান জ্বালানি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এছাড়াও, ওড়িশায় সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সবুজ হাইড্রোজেন করিডর এবং ডিজিটাল অর্থনীতি নিয়ে একাধিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে।

এই সহযোগিতা ভারতের ‘আত্মনির্ভর ভারত’ লক্ষ্য এবং সিঙ্গাপুরের জাতীয় হাইড্রোজেন কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দুই দেশই কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বাণিজ্য ও পরিবেশের উপর প্রভাব
এই গ্রিন শিপিং করিডর শিপিং শিল্পের কার্বন পদচিহ্ন কমাতে সাহায্য করবে। জাহাজগুলো যদি সবুজ হাইড্রোজেন বা অ্যামোনিয়া ব্যবহার করে, তবে ফসিল জ্বালানির উপর নির্ভরতা হ্রাস পাবে। এটি ভারতের প্যারিস চুক্তির প্রতিশ্রুতি পূরণে সহায়ক হবে, যা ভারত ইতিমধ্যে ২০৩০ সালের লক্ষ্যের নয় বছর আগেই অর্জন করেছে।

বাণিজ্যের দিক থেকে, ভারতের সবুজ জ্বালানি রপ্তানি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে। সিঙ্গাপুরের মাধ্যমে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপের মতো বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে। এছাড়াও, এই প্রকল্পে হাজার হাজার কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে।

ভারত এবং সিঙ্গাপুরের মধ্যে গ্রিন ডিজিটাল শিপিং করিডর একটি যুগান্তকারী সহযোগিতা হতে চলেছে। ভারতের সবুজ জ্বালানি উৎপাদন ক্ষমতা এবং সিঙ্গাপুরের শিপিং দক্ষতা একত্রিত হলে, বিশ্বব্যাপী শিপিং শিল্পে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। এই উদ্যোগ শুধু পরিবেশ রক্ষাই করবে না, বরং দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও গভীর করবে। ভবিষ্যতে এই করিডর অন্যান্য দেশের জন্যও একটি মডেল হয়ে উঠতে পারে।