নতুন যুগের সূচনা করতে গিয়ে ভারতীয় ডাক বিভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করল, আগামী ১লা সেপ্টেম্বর ২০২৫ থেকে দেশের ঐতিহ্যবাহী রেজিস্টার্ড পোস্ট পরিষেবার সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে কোটি কোটি ভারতবাসীর নির্ভরযোগ্য যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে পরিচিত এই পরিষেবার বন্ধ হওয়া নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি।
রেজিস্টার্ড পোস্ট — যার মাধ্যমে বহু বছর ধরে সরকারী নিয়োগপত্র, আদালতের নোটিশ, কিংবা গ্রামীণ অঞ্চলের নাগরিকদের জরুরি চিঠিপত্র পাঠানো হত — তা আজ আধুনিকতার চাপে হার মানছে। ভারতীয় ডাক বিভাগের তরফে জানানো হয়েছে, রেজিস্টার্ড পোস্ট পরিষেবাটিকে ১ সেপ্টেম্বর থেকে স্পিড পোস্ট পরিষেবার সঙ্গে একত্রিত করা হবে।
রেজিস্টার্ড পোস্ট: এক প্রজন্মের নির্ভরযোগ্য বন্ধু:
১৯৭০-এর দশকে রেজিস্টার্ড পোস্টের প্রচলন হয় এবং ধীরে ধীরে তা সাধারণ মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। এটি ছিল এমন একটি পরিষেবা, যেখানে চিঠি বা গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পাঠানোর সময় প্রাপককে নির্দিষ্ট করে দেওয়া যেত এবং প্রেরক পেতেন প্রাপ্তির প্রমাণ।
বিশেষ করে গ্রামীণ ভারত এবং সরকারি অফিসগুলোতে এর ব্যবহার ছিল ব্যাপক। আদালত, পুলিশ বিভাগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা স্থানীয় পঞ্চায়েত — সকলেই রেজিস্টার্ড পোস্টের উপর ভরসা রাখত। কিন্তু বিগত দশকে ধীরে ধীরে এর ব্যবহার কমতে শুরু করে।
কমছে জনপ্রিয়তা, বাড়ছে প্রতিযোগিতা:
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরে যেখানে মোট ২৪৪.৪ মিলিয়ন রেজিস্টার্ড পোস্ট পাঠানো হয়েছিল, সেখানে ২০১৯-২০ সালে তা নেমে আসে ১৮৪.৬ মিলিয়নে — অর্থাৎ প্রায় ২৫% হ্রাস। এই পতনের পিছনে রয়েছে বেসরকারি কুরিয়ার সংস্থাগুলির দ্রুতগামী ও প্রযুক্তিনির্ভর পরিষেবা এবং ই-কমার্স সংস্থাগুলির নিজস্ব ডেলিভারি নেটওয়ার্ক।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার — ইমেল, মেসেজিং অ্যাপ, এবং মোবাইলের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের সুবিধা, যা ধীরে ধীরে ঐতিহ্যবাহী ডাক পরিষেবাগুলিকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে।
স্পিড পোস্টে রূপান্তর: সুবিধা ও অসুবিধা:
রেজিস্টার্ড পোস্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এর গুরুত্বপূর্ণ ফিচারগুলি যেমন নিরাপদ হস্তান্তর, প্রাপক-নির্দিষ্ট ডেলিভারি, প্রাপ্তি স্বীকার, ও ট্র্যাকিং আপডেট — সবকিছুই ‘মূল্য সংযোজিত পরিষেবা’ (value-added services) হিসেবে স্পিড পোস্টের অধীনে প্রদান করা হবে।
স্পিড পোস্টের মাধ্যমে দ্রুত এবং আরও নির্ভুল ট্র্যাকিং সুবিধা থাকবে, যা বর্তমান যুগের প্রযুক্তিনির্ভর পরিবেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডাক বিভাগের তরফে দাবি করা হয়েছে, এই রূপান্তরের ফলে সার্বিকভাবে পরিষেবা আরও উন্নত হবে এবং কর্মপদ্ধতিতে আধুনিকতা আসবে।
খরচ বাড়বে, সমস্যায় পড়বে গ্রামীণ ভারত:
তবে এই রূপান্তরের মূল সমস্যাটি হচ্ছে এর খরচ। রেজিস্টার্ড পোস্টের জন্য যেখানে প্রাথমিক মূল্য ছিল ২৫.৯৬ টাকা + প্রতি ২০ গ্রামে ৫ টাকা অতিরিক্ত, সেখানে স্পিড পোস্টের জন্য শুরুতেই ৪১ টাকা গুনতে হবে (৫০ গ্রাম পর্যন্ত)। অর্থাৎ, খরচ প্রায় ২০-২৫% বেশি।
এই বাড়তি খরচ মূলত প্রভাব ফেলবে গ্রামীণ ভারতের উপর, যেখানে সাধারণ মানুষ এখনও রেজিস্টার্ড পোস্টের উপরে নির্ভরশীল। অনেক সময় গ্রামের বাসিন্দারা চাকরির আবেদনপত্র, আইনগত নোটিশ বা ব্যাঙ্কের চিঠি পাঠাতে রেজিস্টার্ড পোস্ট ব্যবহার করতেন, কারণ এটি ছিল সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ।
ঐতিহ্যের অবসান: আবেগ ও বাস্তবতার টানাপোড়েন:
রেজিস্টার্ড পোস্ট শুধু একটি পরিষেবা নয়, এটি ছিল বহু মানুষের আবেগ, যোগাযোগের মাধ্যম এবং সরকারি কর্মপ্রণালির অন্যতম স্তম্ভ। শহরের আধুনিক বাসিন্দাদের কাছে এটি হয়তো অতটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, বহু গ্রামাঞ্চলে আজও এটি একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য চিঠিপ্রেরণের উপায়।
এখন প্রশ্ন উঠছে — স্পিড পোস্টের এই অতিরিক্ত খরচ ও ডিজিটাল নির্ভরতার যুগে ভারতীয় ডাক বিভাগ কি তাদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারবে? ডাক বিভাগের আধিকারিকরা আশ্বাস দিয়েছেন, প্রয়োজনে নতুন মূল্যে ছাড়ের ব্যবস্থা, বা বিকল্প মডেল নিয়ে ভাবা হবে যাতে সাধারণ মানুষ সমস্যায় না পড়েন।
১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ থেকে রেজিস্টার্ড পোস্ট চিরতরে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে। এটি নিঃসন্দেহে ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থার এক যুগের সমাপ্তি। প্রযুক্তির অগ্রগতির এই দৌড়ে যখন প্রাচীন পদ্ধতিগুলি হারিয়ে যেতে বসেছে, তখন রেজিস্টার্ড পোস্টের বিদায় আমাদের মনে করিয়ে দেয় — প্রতিটি প্রযুক্তির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মানুষের আবেগ, স্মৃতি এবং একটুকরো ইতিহাস।