ইলেকট্রনিক্স ক্ষেত্রে চিনা কর্মী প্রত্যাহারে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইলেকট্রনিক্স উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ফক্সকন টেকনোলজি গ্রুপ সম্প্রতি ভারতের আইফোন (Foxconn India) কারখানায় কর্মরত শত শত চীনা প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার…

India Monitors Chinese Workers' Exit from Electronics Sector Amid Foxconn Pullback

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইলেকট্রনিক্স উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ফক্সকন টেকনোলজি গ্রুপ সম্প্রতি ভারতের আইফোন (Foxconn India) কারখানায় কর্মরত শত শত চীনা প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এই পদক্ষেপের ফলে ভারতের মোবাইল উৎপাদন খাতে বড় ধাক্কার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, বিশেষত যখন অ্যাপল ভারতের বাজারে আরও গভীরভাবে প্রবেশ করতে চাইছে এবং উৎপাদন সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়েছে।

সিএনবিসি-টিভি১৮ সূত্র অনুযায়ী, ভারতের সরকার চীনা কর্মীদের এই প্রত্যাহার প্রক্রিয়াকে গভীর নজরে রাখছে। যদিও শিল্প সংক্রান্ত নীতিতে বলা হয়েছে, “কোনও কোম্পানি তার কর্মী নিয়োগে স্বাধীন, এটি সম্পূর্ণভাবে কোম্পানির ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করে যে তারা কোন দেশের নাগরিকদের নিয়ে কাজ করবে বা কীভাবে তাদের ধরে রাখবে।”

   

সরকারি সূত্র আরও জানিয়েছে যে, যেহেতু ভারতের সরকার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত এবং “গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে”, তাই কোম্পানিগুলি চাইলে সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় প্রতিভা খুঁজে বের করা এবং প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা পাবে। সূত্র অনুযায়ী, বিকল্প হিসেবে কোম্পানিগুলি তাইওয়ান বা অন্য কোনো দেশে থেকে প্রতিভা খুঁজে আনতে পারে।

প্রসঙ্গত, ফক্সকন ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলে একটি নতুন আইফোন কারখানা নির্মাণ করছে এবং ২০২৫ সালের শেষ দিকে নতুন আইফোন ১৭ মডেলের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই শতাধিক চীনা প্রকৌশলীকে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় দুই মাস আগে থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ইতিমধ্যেই প্রায় ৩০০ চীনা কর্মী ভারতে থেকে চলে গিয়েছেন। বর্তমানে তাইওয়ানিজ স্টাফরা মূলত ভারতের ফ্যাক্টরিগুলোতে সমন্বয় করছে।

চীনা সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপও এই ঘটনার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। চলতি বছর চীনের সরকার দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্থানীয় প্রশাসনগুলোকে ভারতের মতো দেশগুলোতে প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং সরঞ্জাম রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য উৎসাহিত করেছে। মূলত, চীন তার দেশীয় উৎপাদন সক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে বাইরে যেতে না দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি চীনের একটি সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়া—চীন চায় না তাদের অভিজ্ঞ প্রকৌশলী বা গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি বিদেশে ছড়িয়ে পড়ুক, বিশেষত ভারতের মতো দেশের উৎপাদন খাতে।

অ্যাপলের ক্ষেত্রে, এই ঘটনার প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য এবং প্রযুক্তি উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে অ্যাপল তাদের উৎপাদন ভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিতে চায়, যাতে নির্দিষ্ট কোনো দেশে নির্ভরতা কমানো যায়। ভারতের মতো দেশে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে অ্যাপল চায় স্থানীয় বাজারে তাদের উপস্থিতি বাড়াতে এবং পাশাপাশি বিশ্ববাজারের চাহিদা পূরণ করতে। তবে, চীনা প্রকৌশলীদের অনুপস্থিতি ভারতের কারখানাগুলোতে প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের অভাব তৈরি করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

Advertisements

ভারতের জন্যও এটি এক প্রকার চ্যালেঞ্জ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের মূল লক্ষ্যই ছিল বৈদেশিক বিনিয়োগ ও উৎপাদনকে দেশীয় মাটিতে টানা এবং স্থানীয় কর্মসংস্থান তৈরি করা। চীনা প্রকৌশলীরা মূলত ভারতের স্থানীয় কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও মান নিয়ন্ত্রণের কাজ করছিলেন। তাদের হঠাৎ প্রত্যাহার ভারতের স্থানীয় কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির পরিকল্পনায় বাধা তৈরি করতে পারে।

তবে ভারতের সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, কোম্পানিগুলোর যদি প্রয়োজন হয়, সরকার স্থানীয় প্রতিভা খুঁজে বের করা, প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং দ্রুত প্রতিস্থাপন করার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে। এর পাশাপাশি, প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ যেমন তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান থেকেও দক্ষ কর্মী আনার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।

শিল্প পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই ঘটনা ভারত-চীন সম্পর্কের একটি নতুন মাত্রা যোগ করছে। চীন তার ‘টেকনোলজি ন্যাশনালিজম’ নীতি আরও কড়াভাবে কার্যকর করছে, যেখানে দেশটির প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞ জনশক্তি দেশের বাইরে যেতে না দেওয়ার দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, ভারতের জন্য এটি স্থানীয় জনশক্তি উন্নয়নের জন্য একটি সুযোগও হতে পারে।

সবমিলিয়ে, ফক্সকন-এর এই পদক্ষেপ শুধু অ্যাপলের উৎপাদন পরিকল্পনাতেই প্রভাব ফেলবে না, বরং ভারতের প্রযুক্তি খাতে আত্মনির্ভরতার লক্ষ্যকেও নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করাবে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকার ও শিল্প খাতকে যৌথভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যাতে ভারত প্রযুক্তি উৎপাদনে সত্যিকার অর্থে স্বনির্ভর হতে পারে।