ভারতে ডিজিটাল লেনদেনের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে ইউনিফাইড পেমেন্টস ইন্টারফেস (UPI)। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর একটি নোটে বলা হয়েছে, ভারত এখন বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত পেমেন্ট সম্পন্ন করা দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান মজবুত করেছে।
২০১৬ সালে লঞ্চের পর থেকেই ইউপিআই-এর অগ্রগতি অত্যন্ত দ্রুত। IMF-এর ‘Growing Retail Digital Payments: The Value of Interoperability’ শীর্ষক নোট অনুযায়ী, ইউপিআই বর্তমানে প্রতি মাসে ১৮ বিলিয়নেরও বেশি লেনদেন প্রক্রিয়া করে, যা ভারতের অন্যান্য ইলেকট্রনিক রিটেল পেমেন্ট ব্যবস্থাকে ছাড়িয়ে গেছে।
ইউপিআই ইমিডিয়েট পেমেন্ট সার্ভিস (IMPS)-এর অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা একটি তাৎক্ষণিক পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম। এর ফলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই টাকা স্থানান্তর সম্ভব, যা নগদ লেনদেনের ওপর নির্ভরতা অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে।
ইন্টারঅপারেবিলিটি: ইউপিআই-এর সাফল্যের মূলে:
IMF-এর প্রতিবেদনে ইন্টারঅপারেবিলিটি বা পরস্পর সংযুক্তির গুরুত্বের ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। এই ধারণার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা তাদের পছন্দের অ্যাপ ব্যবহার করে লেনদেন করতে পারে, ফলে তাদের স্বাধীনতা ও সুবিধা দুটোই বৃদ্ধি পায়। একইসাথে, নতুন প্রদানকারীদের প্রবেশের সুযোগ তৈরি হয় এবং বিদ্যমান প্রদানকারীদের নিজেদের সেবা উন্নত করতে উৎসাহিত করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ইন্টারঅপারেবিলিটি থাকলে ডিজিটাল পেমেন্ট গ্রহণের হার বৃদ্ধি পায়, কারণ এটি ব্যবহারকারীদের জন্য আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সুতরাং, শুধুমাত্র বন্ধ-চক্রের (closed-loop) বিকল্পগুলির চেয়ে ইন্টারঅপারেবিলিটি সমৃদ্ধ ব্যবস্থা অনেক বেশি জনপ্রিয় হতে পারে।
সরকারি উদ্যোগের ভূমিকা:
ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (NPCI) ২০১৬ সালের শেষের দিকে ভারত ইন্টারফেস ফর মানি (BHIM) অ্যাপ চালু করে, যখন ইউপিআই-এর ব্যবহার খুব সীমিত ছিল এবং অন্যান্য প্রদানকারীও কম ছিল।
BHIM অ্যাপটি শুরুতে মোট পেয়ার সাইড লেনদেনের মূল্যের অর্ধেকের বেশি দখল করে রেখেছিল। পরে বড় ফিনটেক সংস্থাগুলির নিজস্ব অ্যাপ বাজারে এলে প্রতিযোগিতা বাড়ে। IMF-এর মতে, এই ঘটনা স্পষ্ট করে যে, সরকারি উদ্যোগ সরাসরি ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেমের বিকাশে প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, অনেক সময় ব্যবহারকারী এবং প্রদানকারীর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে ডিজিটাল পেমেন্টের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। যেমন, মানসম্পন্ন অ্যাপের অভাবের কারণে ব্যবহারকারী কমে যায়, আবার ব্যবহারকারীর সংখ্যা কম থাকার কারণে মানসম্পন্ন অ্যাপের বিকাশও হয় না। এই চক্র ভাঙতে সরকারি উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
উল্কাগত বৃদ্ধি:
২০২৫ সালের জুন মাসে ইউপিআই লেনদেনের পরিমাণ ৩২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য। একই সময়ে মোট লেনদেনের মূল্য ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। জুন মাসে দৈনিক ইউপিআই লেনদেনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬১৩ মিলিয়নে, যেখানে মে মাসে ছিল ৬০২ মিলিয়ন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বৃদ্ধি একদিকে যেমন অর্থনীতিতে নগদের ওপর নির্ভরতা কমাচ্ছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক লেনদেনকে আরও স্বচ্ছ ও দ্রুত করছে।
বিশ্বের মঞ্চে ভারতের নেতৃত্ব:
আজ বিশ্বের বহু দেশ ডিজিটাল পেমেন্টের দিকে এগিয়ে গেলেও, ভারত ইউপিআই-এর মাধ্যমে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। IMF-এর মতে, যেসব দেশ নগদ অর্থের ব্যবহার কমিয়ে ডিজিটাল পেমেন্টের দিকে যেতে চায়, তাদের জন্য ইন্টারঅপারেবিলিটি সমৃদ্ধ অবকাঠামো তৈরি করা এবং প্রয়োজন হলে নিয়ন্ত্রক সহায়তা প্রদান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের এই সাফল্য প্রমাণ করে, সঠিক পরিকল্পনা ও সরকার-প্রণোদিত উদ্যোগের মাধ্যমে কীভাবে একটি দেশ স্বল্প সময়ে বিশ্বনেতৃত্বে পৌঁছাতে পারে। ইউপিআই-এর এই অর্জন কেবলমাত্র প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, এটি একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দেয়।
ইউপিআই-এর এই অগ্রগতি ভারতীয় অর্থনীতিকে একটি নতুন দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। নগদমুক্ত অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতে আরও নতুন প্রযুক্তি, আরও বেশি ব্যবহারকারী এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে ইউপিআই তার প্রভাব আরও বিস্তৃত করবে বলে আশা করা যায়।