ভারতের স্বাস্থ্যসেবা (India Healthcare) খাতে ব্যয় ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) ৩.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫ শতাংশে পৌঁছাবে বলে জানিয়েছে কেয়ারএজ রেটিংস-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের বৃদ্ধি, নীতিগত উদ্যোগ এবং জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের ফলে ভারতের স্বাস্থ্যসেবা খাত একটি উল্লেখযোগ্য রূপান্তরের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। বর্তমানে শহর ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো এবং চিকিৎসা পরিষেবার প্রাপ্যতার বৈষম্য থাকলেও, কৌশলগত বিনিয়োগ এবং ক্রমাগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ আশাব্যঞ্জক বলে মনে করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবায় (India Healthcare) ব্যয়ের বৃদ্ধি ও সম্ভাবনা
২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয় জিডিপির ৩.৩ শতাংশ ছিল। কেয়ারএজ রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগামী ছয় বছরে এই ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে জিডিপির ৫ শতাংশে পৌঁছাবে। এই বৃদ্ধির পিছনে রয়েছে সরকারের স্বাস্থ্যসেবায় বাজেট বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি, বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং জনসাধারণের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি। কেয়ারএজ রেটিংস-এর ডিরেক্টর ক্রুণাল মোদি বলেন, “ভারতের স্বাস্থ্যসেবা খাত দ্রুত বদলে যাচ্ছে। সরকারের বর্ধিত ব্যয় এবং বেসরকারি খাতের সহযোগিতা স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতা ও গুণগত মান উন্নত করার জন্য একটি শক্ত ভিত তৈরি করছে।”
তিনি আরও জানান, মেডিকেল শিক্ষার আসন দ্বিগুণ করা, স্বাস্থ্য বীমার আওতা বাড়ানো এবং হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধির মতো পদক্ষেপগুলো একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে ইতিবাচক অগ্রগতি। মোদি জোর দিয়ে বলেন, “আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হলে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। এটি আমাদের স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অর্জন এবং সকল নাগরিকের জন্য উন্নত স্বাস্থ্য ফলাফল নিশ্চিত করবে।”
জনসংখ্যাগত পরিবর্তন ও চাহিদা বৃদ্ধি
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের জনসংখ্যার গঠন পরিবর্তন এবং আয় বৃদ্ধি স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যার অনুপাত উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। এই বয়স্ক জনগোষ্ঠী উন্নত স্বাস্থ্যসেবার জন্য বেশি চাহিদা তৈরি করবে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, “এই চাহিদা মেডিকেল শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, হাসপাতালের অবকাঠামো এবং ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্রযুক্তি জুড়ে স্থায়ী বিনিয়োগে রূপান্তরিত হবে।” ভারতের স্বাস্থ্যসেবা খাত এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে।
বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও সমাধানের পথ
রিপোর্টে ভারতের স্বাস্থ্যসেবা খাতের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরা হয়েছে। শহর এবং গ্রামীণ এলাকার মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর বৈষম্য এখনও একটি বড় সমস্যা। গ্রামীণ এলাকায় দক্ষ চিকিৎসক এবং পর্যাপ্ত হাসপাতালের অভাব রয়েছে। এছাড়া, চিকিৎসা পরিষেবার কর্মীবাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং প্রাপ্যতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেয়ারএজ রিপোর্টে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, ভারতকে সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি এবং গ্রামীণ ও আধা-শহুরে এলাকায় দক্ষ চিকিৎসকদের ধরে রাখার জন্য উপযুক্ত বেতন ও জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করতে হবে।
গ্রামীণ এলাকায় চিকিৎসকদের আকর্ষণ করতে সরকারকে প্রণোদনা প্রদান এবং আধুনিক সুবিধা সহ হাসপাতাল স্থাপনের উপর জোর দিতে হবে। এছাড়া, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্রযুক্তির সম্প্রসারণ গ্রামীণ এলাকায় টেলিমেডিসিন এবং অনলাইন পরামর্শের মাধ্যমে চিকিৎসা পরিষেবার প্রাপ্যতা বাড়াতে পারে। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য বীমার আওতা বৃদ্ধি এবং সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান উন্নত করতে সহায়ক হবে।
নীতিগত উদ্যোগ ও সরকারের ভূমিকা
ভারত সরকার গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে। আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া, জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১৭-এর লক্ষ্য অনুযায়ী, সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় জিডিপির ২.৫ শতাংশ ব্যয় করার পরিকল্পনা করছে। তবে, কেয়ারএজ রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আরও দ্রুত এবং কৌশলগত পদক্ষেপ প্রয়োজন। মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের সংখ্যা বৃদ্ধি, নার্স এবং প্যারামেডিক্যাল কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং প্রাইমারি হেলথ সেন্টারগুলোর আধুনিকীকরণ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে পারে।
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও এই খাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। বেসরকারি হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো উন্নত চিকিৎসা প্রযুক্তি এবং বিশেষায়িত পরিষেবা প্রদান করছে। তবে, এই পরিষেবাগুলো সাশ্রয়ী করা এবং গ্রামীণ এলাকায় সম্প্রসারণ করা জরুরি। ক্রুণাল মোদি বলেন, “শহর ও গ্রামের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার বৈষম্য কমাতে হবে। এর জন্য পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।”
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের স্বাস্থ্যসেবা খাত ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে। মেডিকেল ট্যুরিজম, যা ইতিমধ্যে ভারতের একটি শক্তিশালী খাত, আরও সম্প্রসারিত হবে। উন্নত চিকিৎসা প্রযুক্তি, যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং রোবোটিক সার্জারি, ভারতের স্বাস্থ্যসেবায় নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। এছাড়া, ডিজিটাল হেলথ প্ল্যাটফর্ম এবং মোবাইল হেলথ অ্যাপগুলো স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতা বাড়াতে সহায়ক হবে।
জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের ফলে দীর্ঘস্থায়ী রোগের প্রকোপ বাড়ছে। এটি উন্নত ডায়াগনস্টিক এবং প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা বাড়াবে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতকে এই চাহিদা পূরণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
কেয়ারএজ রিপোর্ট ভারতের স্বাস্থ্যসেবা খাতের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তুলে ধরেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপির ৫ শতাংশে ব্যয় বৃদ্ধি এই খাতের প্রবৃদ্ধি এবং গুণগত উন্নতির ইঙ্গিত দেয়। তবে, শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য কমানো, দক্ষ চিকিৎসকদের ধরে রাখা এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সম্প্রসারণ এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে ভারত একটি শক্তিশালী এবং সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে, যা সকল নাগরিকের জন্য উন্নত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে।