ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার (India Forex Reserves) গত নভেম্বরের পর থেকে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে, যা ৬৮৬.১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এই বৃদ্ধি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও ভারতীয় অর্থনীতির স্থিতিস্থাপকতার একটি শক্তিশালী প্রমাণ। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (RBI) তথ্য অনুযায়ী, ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত সপ্তাহে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার ৮.৩১ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা টানা সপ্তম সপ্তাহের বৃদ্ধি। এর আগের সপ্তাহে, অর্থাৎ ১১ এপ্রিল পর্যন্ত সপ্তাহে, ভাণ্ডারে ১.৫৭ বিলিয়ন ডলারের বৃদ্ধি দেখা গিয়েছিল।
গত বছর সেপ্টেম্বরে ৭০০ বিলিয়ন ডলারের শীর্ষ থেকে তীব্র পতনের পর বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার করছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এই ভাণ্ডার সর্বকালের সর্বোচ্চ ৭০৪.৮৮৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। এই সাম্প্রতিক বৃদ্ধি ভারতের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়।
বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারের উপাদান:
১৮ এপ্রিল পর্যন্ত সপ্তাহের তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারের প্রধান উপাদান—বিদেশী মুদ্রা সম্পদ—৫৭৮.৪৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এছাড়া, সোনার মজুদ ৪.৫৭৫ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়ে ৮৪.৫৭২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আরবিআই জানিয়েছে, বিশেষ অঙ্কন অধিকার (এসডিআর) ২১২ মিলিয়ন ডলার বেড়ে ১৮.৫৬৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) ভারতের রিজার্ভ পজিশন ৭ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়ে ৪.৫১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
এই বৈচিত্র্যময় উপাদানগুলির বৃদ্ধি ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারের শক্তি এবং এর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষমতাকে তুলে ধরে। বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার আমদানি ব্যয় মেটানো, ঋণ পরিশোধ এবং মুদ্রার স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আর্থিক বাজারের গতিশীলতা:
আরবিআই গভর্নর সঞ্জয় মালহোত্রার মতে, ভারতের আর্থিক বাজারগুলি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি গতিশীল এবং স্থিতিস্থাপক শক্তি হিসেবে বিকশিত হয়েছে। ২০২০ সালে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের আকার ছিল ৩২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। একই সময়ে, রাত্রিকালীন অর্থ বাজারে গড় দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ৩ লক্ষ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৫.৪ লক্ষ কোটি টাকার উপরে পৌঁছেছে।
সরকারি সিকিউরিটিজ (জি-সেক) বাজারেও গড় দৈনিক লেনদেন ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৬৬,০০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। মালহোত্রা জানিয়েছেন, বৈদেশিক মুদ্রা, জি-সেক এবং অর্থ বাজার সহ ভারতের সমস্ত আর্থিক বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। কয়েক মাস আগে রুপি কিছুটা চাপের মুখে পড়লেও, এটি পরবর্তীতে পুনরুদ্ধার করেছে এবং হারানো অবস্থানের কিছুটা পুনরুদ্ধার করেছে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার তাৎপর্য:
বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারের এই বৃদ্ধি ভারতের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপের মধ্যেও ভারতের অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে। এই ভাণ্ডার আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য প্রায় ১২ মাসের কভারেজ প্রদান করে, যা ভারতকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষম করে।
RBI-এর সক্রিয় নীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনা বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারের পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রুপির মান স্থিতিশীল রাখতে এবং বাজারের অস্থিরতা কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক নিয়মিত হস্তক্ষেপ করে। এছাড়া, ভারতের ক্রমবর্ধমান রপ্তানি, প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং রেমিট্যান্সও বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।
আর্থিক বাজারের প্রবৃদ্ধি:
ভারতের আর্থিক বাজারের দ্রুত প্রসার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি এবং অর্থ ও জি-সেক বাজারে লেনদেনের বৃদ্ধি দেশের আর্থিক অবকাঠামোর শক্তি প্রদর্শন করে। এই বাজারগুলি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ায় এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে ত্বরান্বিত করে।
মালহোত্রার মতে, ভারতের আর্থিক বাজারগুলি বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে। রুপির স্থিতিশীলতা এবং বাজারের স্থিতিশীলতা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করছে। এছাড়া, RBI-এর ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি উদ্যোগগুলি দেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করেছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা:
বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারের এই ধারাবাহিক বৃদ্ধি ভারতের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক সংকেত। এটি বিশ্বব্যাপী বাজারে ভারতের অবস্থানকে আরও মজবুত করবে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে। তবে, বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি, তেলের দামের অস্থিরতা এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার মতো চ্যালেঞ্জগুলি ভবিষ্যতে প্রভাব ফেলতে পারে।
RBI-এর সতর্ক নীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনা এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ হবে। এছাড়া, ভারতের ক্রমবর্ধমান রপ্তানি এবং পরিষেবা খাতের প্রবৃদ্ধি বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারকে আরও শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে।
ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারের সাম্প্রতিক বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা এবং আর্থিক বাজারের গতিশীলতার প্রমাণ। ৬৮৬.১৪ বিলিয়ন ডলারের এই ভাণ্ডার ভারতকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম করে তুলেছে। আরবিআই-এর সক্রিয় ভূমিকা, আর্থিক বাজারের প্রবৃদ্ধি এবং রুপির পুনরুদ্ধার ভারতের অর্থনৈতিক শক্তির প্রতিফলন ঘটায়। ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত থাকলে, ভারত বিশ্ব অর্থনীতিতে আরও প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করবে।