ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার বা ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ (India forex reserves) আবারও ঊর্ধ্বমুখী। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (RBI)-এর সর্বশেষ সাপ্তাহিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২৯ আগস্টে শেষ হওয়া সপ্তাহে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯৪.২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এই সময়ে রিজার্ভের বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন ডলার, যার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল বৈদেশিক মুদ্রা সম্পদ এবং সোনার মূল্যের বৃদ্ধি।
রিজার্ভ ব্যাংকের তথ্যমতে, বর্তমানে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্তরের কাছাকাছি পৌঁছেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রিজার্ভ একসময় পৌঁছে গিয়েছিল ৭০৪.৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সর্বকালের রেকর্ডে। নতুন করে হওয়া এই বৃদ্ধি আবারও দেশকে সেই রেকর্ড স্পর্শ করার দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের সবচেয়ে বড় অংশ হলো বৈদেশিক মুদ্রা সম্পদ বা Foreign Currency Assets (FCA)। সর্বশেষ সপ্তাহে FCA বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮৩.৯৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। অর্থাৎ, এক সপ্তাহে বেড়েছে প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ডলার। FCA মূলত ডলারসহ বিভিন্ন বৈদেশিক মুদ্রায় রাখা সম্পদ, যার মধ্যে থাকে আমেরিকান ট্রেজারি বন্ড, বিদেশি ব্যাংকের আমানত এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্পদ।
RBI-এর সাপ্তাহিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সোনার ভান্ডারেও যথেষ্ট বৃদ্ধি ঘটেছে। বর্তমানে ভারতের সোনার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৮৬.৭৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের সপ্তাহ থেকে ১.৮ বিলিয়ন ডলার বেশি। বৈশ্বিক বাজারে সোনার দামের উত্থান এবং RBI-এর কৌশলগত ক্রয় নীতিই এই বৃদ্ধির মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। সোনা ঐতিহ্যগতভাবে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের অন্যতম নিরাপদ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
রিজার্ভ ব্যাংকের সর্বশেষ নীতি পর্যালোচনা বৈঠকের পর গভর্নর সঞ্জয় মালহোত্রা জানান, ভারতের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার (India forex reserves) দেশের প্রায় ১১ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে যথেষ্ট। এই তথ্য আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের আর্থিক স্থিতি ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার একটি ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে।
সংখ্যাগুলো তুলনা করলে দেখা যায়, ২০২২ সালে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে (India forex reserves) প্রায় ৭১ বিলিয়ন ডলারের হ্রাস হয়েছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে আবার উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে রিজার্ভে যোগ হয় প্রায় ৫৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বৃদ্ধি হলেও ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসেই ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় ৫৩ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালেই ভারত আবারও ইতিহাসের সর্বোচ্চ রিজার্ভ রেকর্ড ছুঁতে বা অতিক্রম করতে পারে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কোনো দেশের অর্থনৈতিক শক্তির অন্যতম প্রধান সূচক। রিজার্ভ যত বেশি হয়, দেশ তত বেশি সময় আন্তর্জাতিক ধাক্কা সামলাতে পারে। যেমন— আমদানি খরচ মেটানো, বৈদেশিক ঋণ শোধ করা, মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করা।
ভারতের ক্ষেত্রে, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ মূলত রাখা হয় মার্কিন ডলার আকারে। তবে পাশাপাশি ইউরো, জাপানি ইয়েন এবং ব্রিটিশ পাউন্ডের মতো মুদ্রাও রিজার্ভে রয়েছে।
রিজার্ভ ব্যাংক প্রায়শই মুদ্রা বাজারে হস্তক্ষেপ করে রুপির অস্বাভাবিক পতন রোধ করতে। যখন রুপি দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন RBI বাজারে ডলার বিক্রি করে রুপির মান ধরে রাখে। আবার যখন রুপি তুলনামূলক শক্তিশালী হয়, তখন RBI ডলার কেনে, যাতে ভবিষ্যতের জন্য রিজার্ভ শক্তিশালী থাকে।
এই কৌশলকে বলা হয় “liquidity management” বা তারল্য ব্যবস্থাপনা। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে রুপির মান স্থিতিশীল থাকে, যা আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা সত্ত্বেও ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডারের এই বৃদ্ধি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বৈশ্বিক সুদের হার বৃদ্ধি, ভূরাজনৈতিক সংঘাত এবং বাণিজ্যিক অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও ভারত তার মুদ্রা রিজার্ভ বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। এতে বোঝা যায়, দেশের রপ্তানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং প্রবাসী আয় ভারতের অর্থনীতিকে শক্তিশালী রাখছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভারতের রিজার্ভ যত বাড়বে, ততই দেশ আন্তর্জাতিক মঞ্চে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রদর্শন করতে পারবে। একই সঙ্গে মুদ্রা সংকট বা বৈশ্বিক বাজারে ধাক্কা সামাল দেওয়ার ক্ষমতাও বহুগুণ বাড়বে।
ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ধারাবাহিক বৃদ্ধি দেশের জন্য আশাব্যঞ্জক। RBI-এর বিচক্ষণ নীতি, রপ্তানি খাতের উন্নতি, প্রবাসী ভারতীয়দের রেমিট্যান্স এবং সোনার মূল্যে উত্থান—সব মিলিয়ে ভারতের অর্থনৈতিক ভান্ডার আরও মজবুত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার চাপ এবং বিশ্বব্যাপী অস্থির পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও ভারত বর্তমানে এশিয়ার অন্যতম স্থিতিশীল অর্থনীতি হিসেবে নিজের অবস্থান আরও দৃঢ় করছে।