বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও ভারতীয় রপ্তানিকারকরা (India Export ) অভূতপূর্ব স্থিতিস্থাপকতা এবং উদ্ভাবনী দক্ষতা দেখিয়েছেন—এমনই মন্তব্য করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। সোমবার এক্সিম ব্যাংক আয়োজিত ট্রেড কনক্লেভে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ভারতের মোট রপ্তানি বেড়ে ৮২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা বিগত বছরের তুলনায় ৬ শতাংশ বৃদ্ধি। ২০১৩-১৪ সালে এই অঙ্ক ছিল ৪৬৬ বিলিয়ন ডলার।
অর্থমন্ত্রী বলেন, “যখন বিশ্বজুড়ে ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত, সরবরাহ ব্যবস্থার বিঘ্ন এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছে, তখন ভারতের রপ্তানিকারকরা সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। এটি ভারতীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক লক্ষণ।”
বিশ্বজুড়ে অস্থির পরিস্থিতি:
সীতারামন স্মরণ করিয়ে দেন যে, বিগত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চরম চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইজরায়েল-গাজা সংঘাত, এবং অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে ভারতের রপ্তানির বৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যেখানে বিশ্বব্যাপী গড় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৪ শতাংশ।
তিনি বলেন, “প্রতি বছরই কোনও না কোনও বড় ধরণের সংঘাত দেখা যাচ্ছে, যা বাণিজ্যকে প্রভাবিত করছে। এর মধ্যেও আমাদের রপ্তানিকারকেরা যে ভাবে টিকে আছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে, তা প্রশংসনীয়।”
রপ্তানিকারকদের তিনটি বিশেষ গুণ:
অর্থমন্ত্রী রপ্তানিকারকদের সফলতার পেছনে তিনটি মুখ্য গুণের উল্লেখ করেন:
1. ক্রমাগত বৃদ্ধি:
ভারতীয় রপ্তানির ধারাবাহিক ও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধিকে তিনি প্রথম গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, “রপ্তানি শুধু হচ্ছে না, বরং যথেষ্ট মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
2. প্রযুক্তি-ভিত্তিক এবং উচ্চমানসম্পন্ন পণ্য রপ্তানি:
সীতারামন জানান, আজকের ভারত কেবল কৃষিপণ্য বা কাঁচা পণ্য রপ্তানির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। “ভারত এখন ভালোভাবে প্রকৌশলকৃত এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রযুক্তি-ভিত্তিক পণ্য রপ্তানি করছে,” বলেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে ফার্মাসিউটিক্যালস, আইটি-সংক্রান্ত পরিষেবা এবং অটোমোবাইলস।
3. বাজার বহুমুখীকরণ:
ভারতীয় কোম্পানিগুলো কেবলমাত্র ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্যিক অংশীদারদের ওপর নির্ভর না করে নতুন বাজার খুঁজে নিচ্ছে, যা তাদের রপ্তানিকে স্থিতিশীল এবং দীর্ঘস্থায়ী করছে।
রপ্তানির মানচিত্রে রূপান্তর:
অর্থমন্ত্রী মনে করেন, এই প্রবণতাগুলো ভারতের রপ্তানি প্রোফাইলকে সম্পূর্ণ রূপে পরিবর্তন করেছে। অতীতের তুলনায় এখন ভারত অনেক বেশি পরিশীলিত, প্রযুক্তিনির্ভর এবং উচ্চ-মূল্য সংযোজন সম্পন্ন পণ্য ও পরিষেবা রপ্তানি করছে। এতে ভারতের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলকতা যেমন বাড়ছে, তেমনি ভালো দামে পণ্য বিক্রির সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, “এই রূপান্তর দেখিয়ে দিচ্ছে যে ভারত কেবল পরিমাণে নয়, মানের দিক দিয়েও বিশ্ববাজারে শক্ত অবস্থান তৈরি করছে।”
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের গুরুত্ব:
সীতারামন বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, রপ্তানি খাতে নতুন প্রবেশকারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সংস্থাগুলিকে সহায়তা করা এখন অত্যন্ত প্রয়োজন। “বহির্বিশ্বে চ্যালেঞ্জ থাকলেও, এই ছোট ছোট এককগুলিকে উৎসাহ প্রদান করলে তা জাতীয় রপ্তানি বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখবে,” তিনি বলেন।
তিনি জানান, সরকারের পক্ষ থেকে নীতি-সহায়তা, আর্থিক অনুদান, সহজতর রপ্তানি লাইসেন্স প্রক্রিয়া এবং প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসএমইগুলিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি:
ভারত এখন এমন এক সময় দাঁড়িয়ে যেখানে উচ্চমানসম্পন্ন রপ্তানি ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বাজারের মাধ্যমে নিজেদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আরও শক্তিশালী করে তোলার সুযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলি যেমন থাকবে, তেমনি ভারতের রপ্তানিকারকদের উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিযোজন ক্ষমতা আগামী দিনে বড় সাফল্য বয়ে আনতে পারে।
সীতারামন বলেন, “যত বেশি আমরা আমাদের উৎপাদনের মান বাড়াতে পারবো এবং নতুন বাজারে পৌঁছাতে পারবো, তত বেশি আমাদের রপ্তানি খাতে টেকসই উন্নয়নের সম্ভাবনা তৈরি হবে।”
বিশ্ব যখন একের পর এক সঙ্কটে জর্জরিত, তখন ভারতের রপ্তানি খাতে এই সাফল্য নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। সরকারের সক্রিয় সহায়তা, শিল্পের উদ্ভাবনী মনোভাব এবং প্রযুক্তিনির্ভরতার উপর ভর করেই ভারত আগামীতে আরও উচ্চতর বাণিজ্যিক লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে—এমনটাই আশা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।