বিশ্বের নানা প্রান্তে বাজার যখন অনিশ্চয়তা ও মন্দার সঙ্গে লড়াই করছে, তখন ভারত তার নিজস্ব শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে। বহুজাতিক ভোগ্যপণ্য (Consumer Goods) নির্মাতা সংস্থাগুলির কাছে ভারত এখন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। যদিও শহরাঞ্চলে চাহিদা কিছুটা কমেছে, তবুও ভারতের সামগ্রিক বাজারের প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদী সংস্থাগুলি।
সম্প্রতি দ্য ইকোনমিক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে, ইউনিলিভার, প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল (পিএন্ডজি), পারনোড রিকার্ড, রেকিট, পেপসিকো, হেইনেকেন এবং লরিয়ালের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির শীর্ষ কর্মকর্তারা ভারতের বাজারে শক্তিশালী অবদানের কথা তুলে ধরেছেন। তারা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক ত্রৈমাসিকে ভারতের বাজার নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলেছে।
পিএন্ডজি-র চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার আন্দ্রে শাল্টেন বলেন, “ভারত মাঝারি একক অঙ্কের হারে খুব ভালোভাবে প্রবৃদ্ধি চালাচ্ছে। যতবার ভারতের দিকে তাকাই, বাজার আরও উন্নত দেখায়। আমরা এখানে বড়সড় প্রবৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে খুবই আশাবাদী।”
গত এক দশকে ভারতের গ্রামীণ বাজার, যেখানে ৮০ কোটি মানুষ বাস করেন, ভোগ্যপণ্য বিক্রির অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। গ্রামীণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কৃষিজ উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় সাম্প্রতিক ত্রৈমাসিকগুলিতে বাজারে আবার চাঙ্গাভাব দেখা যাচ্ছে। যদিও শহরাঞ্চলে মজুরি বৃদ্ধির গতি মন্থর এবং মূল্যবৃদ্ধির কারণে খরচের প্রবণতা কমেছে, ফলে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শহুরে চাহিদা কিছুটা দুর্বল রয়ে গেছে।
কোলগেট-পামোলিভের সিইও নোয়েল ওয়ালেস বলেন, “ভারতের শহরাঞ্চলে বাজার এখনও দুর্বল রয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম যে এই বছরই কিছুটা ঘুরে দাঁড়াবে, কিন্তু তা প্রত্যাশিত গতিতে হয়নি।”
এত কিছুর পরেও, প্রিমিয়াম পণ্যগুলির চাহিদা দৃঢ় থেকে গেছে। পেপসিকো, রেকিট ও লরিয়াল-এর মতো সংস্থাগুলি জানিয়েছেন, তারা মার্চ ত্রৈমাসিকে উদীয়মান বাজারগুলিতে বিশেষ করে ভারতে শক্তিশালী পারফরম্যান্স করেছে।
ইউনিলিভার ও পারনোড রিকার্ডের জন্য ভারত এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার। যদিও শহরাঞ্চলের দুর্বলতা ভারতের বাজারকে বিশ্বের দ্রুততম বৃদ্ধিশীল বাজারের তালিকা থেকে কিছুটা পিছিয়ে দিতে পারে, তবুও সংস্থাগুলি ভারতের বাজারকে নিজেদের বৃদ্ধির মূল স্তম্ভ হিসেবে দেখছে।
ইউনিলিভারের সিইও ফার্নান্দো ফার্নান্দেজ বলেন, “ভারত এমন একটি বাজার, যেখানে আমরা কোনওভাবেই ছাড় দেব না। আমরা জানি, একবার আমাদের প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন সচল হলে, আমরা আয় বৃদ্ধিকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।”
পারনোড রিকার্ড, যেটি অ্যাবসোলুট ভদকা ও চিভাস রিগাল স্কচ হুইস্কির মতো প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের মালিক, জানিয়েছে যে, ভারতে প্রিমিয়াম পণ্যের চাহিদা এবং বিক্রিতে ধারাবাহিক বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।
হেইনেকেনের চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার হ্যারাল্ড ভ্যান ডেন বুকও ভারতের বাজার নিয়ে আশাবাদী। তিনি জানিয়েছেন, “ভারতে বিয়ারের ভলিউম মাঝারি একক অঙ্কে বেড়েছে এবং প্রিমিয়াম সেগমেন্টে ২০ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কৃষি উৎপাদন ভালো হলে গ্রামীণ বাজার আরও চাঙ্গা হবে, এবং সরকারী নীতিমালা ও অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ শহরাঞ্চলেও খরচের ধারায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। পাশাপাশি, তরুণ জনগোষ্ঠী, ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং প্রযুক্তি ও ই-কমার্সের প্রসারের কারণে ভারতের বাজারে বহুজাতিক সংস্থাগুলির আস্থা আরও দৃঢ় হচ্ছে।
পাশাপাশি, ব্র্যান্ডগুলি এখন প্রিমিয়াম এবং উচ্চ-মূল্যের পণ্যগুলিতে আরও বেশি করে বিনিয়োগ করছে, যেখানে গ্রাহকদের ব্যয় করার ইচ্ছা তুলনামূলক বেশি রয়েছে।
সার্বিকভাবে, যদিও নগরাঞ্চলে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে, তবে ভারতের বাজারের দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। বহুজাতিক সংস্থাগুলি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, আগামীদিনে তারা ভারতের বাজারে নিজেদের উপস্থিতি আরও জোরদার করবে এবং প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।