ভারত সরকার ২০৪৭ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত অর্থনীতির মর্যাদায় পৌঁছে (India economy growth) দেওয়ার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ‘বিকশিত ভারত’ কর্মসূচির আওতায় এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে আগামী এক দশক ধরে গড়ে ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি সংসদের এক কমিটিকে জানিয়েছে, আগামী দশকে ভারতের অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে বছরে প্রায় ৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলে তবেই ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত অর্থনীতির তালিকায় নাম লিখতে পারবে দেশ। জুন মাসে দেওয়া এই বক্তব্য আগস্ট ১৯ তারিখে প্রকাশ্যে আসে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে (যা শেষ হবে আগামী ৩১ মার্চ) ভারতের প্রবৃদ্ধি ৬.৩ থেকে ৬.৮ শতাংশের মধ্যে থাকবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। গত বছর প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৬.৫ শতাংশ। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি—৯.২ শতাংশ।
সরকারি অনুমান অনুযায়ী, এ বছরের প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল হলেও তা ৮ শতাংশ লক্ষ্যের চেয়ে অনেক কম। ফলে ধারাবাহিক উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতে, উন্নত অর্থনীতির মর্যাদায় পৌঁছতে হলে শুধু প্রবৃদ্ধিই নয়, বিনিয়োগের হারও বাড়াতে হবে। বর্তমানে ভারতের মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) প্রায় ৩১ শতাংশ বিনিয়োগে ব্যয় হয়। লক্ষ্য পূরণ করতে হলে এই হারকে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ৩৫ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়ন, উৎপাদন খাত ও প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধিকে এখানে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, আগামী দিনের প্রবৃদ্ধি প্রধানত দেশীয় চাহিদা ও বিনিয়োগ থেকেই আসবে। বিশ্ববাজারে অনিশ্চয়তা বাড়তে থাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এই কারণে সরকার অভ্যন্তরীণ ভোক্তা বাজার চাঙ্গা রাখতে কর ছাড়, ভর্তুকি ও অবকাঠামো প্রকল্পে নজর দিচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে ব্যক্তিগত আয়করে ছাড় দেওয়ার পর আবারও ভোক্তাদের জন্য কর হ্রাসের পরিকল্পনা চলছে।
অন্যদিকে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কও অর্থনীতিতে গতি আনতে চলতি বছরে সুদের হার একশো বেসিস পয়েন্ট কমিয়েছে। এতে শিল্প ও পরিষেবা খাতে বিনিয়োগে গতি আসবে বলে আশা করছে কেন্দ্র।
প্রবৃদ্ধির অন্যতম বড় বাধা হিসেবে উঠে আসছে বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের টানাপোড়েন ভারতের জন্য উদ্বেগজনক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন যে ভারত থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের ওপর মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক ধার্য হবে। এর আগে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার ফলে এই হার দ্বিগুণ হয়েছে।
মার্কিন প্রশাসন বলছে, রাশিয়া থেকে তেল কেনার জন্যই ভারতের ওপর এই ‘শাস্তিমূলক’ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতে, এই অতিরিক্ত শুল্ক ভারতের প্রবৃদ্ধি আগামী অর্থবছরে প্রায় ৪০ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আলোচনাতেও জটিলতা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি বৈঠকে দিল্লি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে কৃষি ও দুগ্ধ বাজারে আমেরিকাকে প্রবেশাধিকার দেওয়া সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় কৃষি ও দুগ্ধ খাতের বাজার চেয়েছিল, কিন্তু দেশীয় উৎপাদকদের স্বার্থে ভারত তাতে রাজি হয়নি।
অন্যদিকে, ভারত চাইছে শ্রমনির্ভর শিল্প—যেমন টেক্সটাইল, পোশাক ও চামড়াজাত দ্রব্য—যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে বাড়তি সুবিধা পাক। এই খাতগুলোতে রপ্তানি বাড়াতে পারলেই কর্মসংস্থানের বড় সুযোগ তৈরি হবে এবং অর্থনীতিও গতি পাবে বলে মনে করছে কেন্দ্র।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে প্রবৃদ্ধি ৮ থেকে ৯ শতাংশে ধরে রাখতে হবে। তবে শুধু সংখ্যার দৌড় নয়, প্রবৃদ্ধিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই করাও জরুরি।
তাদের মতে, উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্র, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামো ও প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক সংস্কার দরকার। পাশাপাশি নারীশক্তির শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বাড়ানোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্পষ্টতই, ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত অর্থনীতির মর্যাদা অর্জন ভারতের জন্য একটি দীর্ঘ ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ যাত্রা। একদিকে রয়েছে উচ্চ প্রবৃদ্ধির প্রয়োজন, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও ভূরাজনীতির অস্থিরতা। তবে সরকার যদি দেশীয় চাহিদা বাড়ানো, বিনিয়োগ উৎসাহিত করা এবং রপ্তানি খাতকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপে সফল হয়, তবে লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব নয়।
অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, “এটি একটি ম্যারাথন দৌড়, স্প্রিন্ট নয়।” আগামী এক দশকের ধারাবাহিক নীতি ও সঠিক কৌশলই নির্ধারণ করবে, ভারত ২০৪৭-এ সত্যিই উন্নত অর্থনীতির আসনে বসতে পারবে কি না।