সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সংঘটিত জঙ্গি হামলা গোটা ভারতকে (India) স্তম্ভিত করেছে। গত ২২ এপ্রিল, নিরীহ পর্যটকদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়, যাতে প্রাণ হারান অন্তত ২৬ জন সাধারণ নাগরিক। তদন্তে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদতের প্রমাণ মিলেছে। এর জবাবে ভারত সরকার দ্রুত এবং কঠোর পদক্ষেপ নেয়—পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়েছে। একই সঙ্গে, ঐতিহাসিক সিন্ধু জলচুক্তি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে এবং দুই দেশের মধ্যে সমস্ত ধরনের বাণিজ্যিক লেনদেন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
ভারতের এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের জন্য ভয়াবহ আর্থিক সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বরাবরই সীমিত ছিল, তবে তা ভারতের পক্ষেই ছিল অত্যন্ত লাভজনক। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের এপ্রিল থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতের পাকিস্তানে রফতানির পরিমাণ ছিল ৪৪৭.৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৩,৭৩৫ কোটি টাকা। বিপরীতে পাকিস্তান থেকে ভারতের আমদানি ছিল মাত্র ০.৪২ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৩.৫ কোটি টাকার সমান।
Also Read | পহেলগাঁও হামলায় কাশ্মীরের পর্যটন ও সিনেমা শিল্প বিপর্যস্ত
এই পরিসংখ্যানই পরিষ্কার করে দেয়, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ হওয়ায় পাকিস্তান বড়সড় সমস্যায় পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বাজারে ভারতের ওষুধ, রাসায়নিক দ্রব্য, কৃষিজ পণ্য এবং হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং সামগ্রীর চাহিদা ছিল যথেষ্ট। এসব পণ্য এখন হঠাৎ করে বন্ধ হওয়ায়, পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিক এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলি চরম সংকটে পড়েছে।
ভারতের জন্যও অবশ্য এই সিদ্ধান্তের আর্থিক প্রভাব কিছুটা রয়েছে। বিশেষত, যেসব ছোট ও মাঝারি শিল্প সংস্থা পাকিস্তানে পণ্য রফতানি করত, তারা এখন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশিষ্ট বাণিজ্য বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পাকিস্তান যদিও ভারতের সামগ্রিক রফতানির খুব ছোট একটি অংশ ছিল, তবুও নির্দিষ্ট কিছু খাতে, বিশেষত কৃষিপণ্য ও ওষুধ শিল্পে সাময়িক চাপ তৈরি হবে। একজন বিশ্লেষকের ভাষায়, “পাকিস্তান ভারতের একাধিক ছোট-মাঝারি শিল্প সংস্থার জন্য একটি স্থিতিশীল বাজার ছিল। এখন সেই বাজার হারিয়ে তারা নতুন বাজার খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে।”
ভারতের রফতানি তালিকায় উল্লেখযোগ্য ছিল চিনি, তুলা, রাসায়নিক সার, ওষুধ, চা ও অন্যান্য কৃষিপণ্য। এছাড়াও, নির্মাণ সামগ্রী এবং হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য পাকিস্তানে ভারতের অন্যতম রফতানি সামগ্রী ছিল। ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও এতদিন ধরে সীমিত আকারে হলেও এই বাণিজ্য চলছিল। এখন সেই দরজা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।
Also Read | সীমান্তে উত্তেজনা, জেলের ভেতরে ধোঁয়াশা—পাকিস্তানি বন্দিদের ভাগ্য কী?
পাকিস্তান থেকেও কিছু পণ্য ভারত আমদানি করত, যেমন শুকনো ফল, কাঁচা লবণ ও কিছু প্রাকৃতিক সামগ্রী। তবে এই আমদানি অত্যন্ত সীমিত ছিল এবং ভারতের বাজারে এর তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না বলেই মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
সরকারি স্তরে জানানো হয়েছে, দেশের নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির অংশ হিসেবেই এই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যদিও সাময়িকভাবে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, ভারত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে—সন্ত্রাসে মদতদানের জন্য কোনো রকম ছাড় দেওয়া হবে না। পাশাপাশি, সরকার নতুন রফতানি বাজারের সন্ধানে উদ্যোগী হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলিতে ভারতের রফতানির সুযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে একাধিক কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রচেষ্টা চলছে।
উল্লেখযোগ্য, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামা হামলার পরও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভেঙে পড়েছিল। তখন পাকিস্তান ভারতের পণ্যের উপর ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল। তবে তাতেও সীমিত আকারে কিছু বাণিজ্য চালু ছিল। এবারে, ২০২৫ সালে সম্পূর্ণরূপে আমদানি-রফতানি বন্ধ হওয়া দুই দেশের সম্পর্কের ইতিহাসে এক নতুন মোড় আনলো।
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের উচিত দ্রুত বিকল্প রফতানি বাজার খুঁজে বের করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পগুলিকে সরকারি আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। পাশাপাশি, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের কূটনৈতিক প্রচার আরও জোরদার করার প্রয়োজন রয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয়।