ভারতের আমদানি বাজারে চীনের প্রভাব ধীরে ধীরে কিন্তু নির্দয়ভাবে (India-China trade) বাড়ছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, চীন ভারতের মোট পণ্য আমদানির একটি বড় অংশ দখল করে নিয়েছে, যা ১৯৯৮-৯৯ সালে মাত্র ২.৫৯ শতাংশ থেকে ২০২৪-২৫ সালে ১৫.৭২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই বৃদ্ধির পেছনে চীনের বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলা (সাপ্লাই চেইন) নিয়ন্ত্রণ এবং বিশেষ করে ইলেকট্রনিক উপাদানে তার অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে। এই তথ্যটি ভারতের “আত্মনির্ভর ভারত” অভিযানের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যেখানে দেশটি স্বাবলম্বনের পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
১৯৯৮-৯৯ সালে চীন ভারতের আমদানির শুধুমাত্র ২.৫৯ শতাংশ দখল করেছিল, কিন্তু ২০০৩-১৪ সালের মধ্যে এটি বেড়ে ৫.১৯ শতাংশে পৌঁছায়। ২০১৩-১৪ সালে এই হার ১১.৩৩ শতাংশ হয়ে ওঠে, যা ২০১৮-১৯ সালে ১৩.৬৮ শতাংশে উন্নীত হয়। সর্বশেষে ২০২৩-২৪ সালে এটি ১৫ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ সালে ১৫.৭২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা একটি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি নির্দেশ করে। বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় (এমওসি) থেকে প্রকাশিত এই তথ্য অনুসারে, চীনের সাথে ভারতের বাণিজ্যিক নির্ভরতা ক্রমশ বাড়ছে, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি এবং ফার্মাসিউটিকাল উপাদানের ক্ষেত্রে।
চীনের এই প্রভাব বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, চীন বিশ্বের বৃহত্তম উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়, যেখানে সস্তা শ্রমবল এবং উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন খরচ কম। দ্বিতীয়ত, চীন বিশ্বের ইলেকট্রনিক উপাদান বাজারে প্রায় ৬৫ শতাংশ অংশ দখল করে (রোডিয়াম গ্রুপ, ২০২৩), যা ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিকল্প সন্ধান করা কঠিন করে তুলেছে। তৃতীয়ত, ভারতের নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা এখনো সেই স্তরে পৌঁছায়নি, যা বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৮ রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতকে বিশ্ব উৎপাদন সূচকায় ৩০তম স্থানে রাখে, যেখানে চীন ৫ম স্থানে আছে।
“আত্মনির্ভর ভারত” অভিযানের মাধ্যমে সরকার গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে, তথাপি চীনের উপর নির্ভরতা কমছে না। ২০২৪ সালে জাতীয় পরিসংখ্যান কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের চীন থেকে আমদানি ১২৬.৯৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা বাণিজ্য ঘাটতি বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের এই নির্ভরতা অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য একটি ঝুঁকি হতে পারে, বিশেষ করে যখন দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত উদ্বেগ চলমান রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে, ভারতকে চীনের উপর নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প সরবরাহ সূত্র খুঁজতে হবে। দেশটির সরকার এখন উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য চুক্তি স্থাপন করছে, যেমন ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে। তবে, চীনের মতো স্কেল এবং মূল্য প্রতিযোগিতা দ্রুত গড়ে তোলা সম্ভব নয়। অর্থনীতিবিদরা পরামর্শ দিয়েছেন যে, ভারতের উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং দক্ষ শ্রমবল তৈরি করা জরুরি, যা দীর্ঘমেয়াদীভাবে দেশকে স্বাবলম্বী করতে সাহায্য করবে।
সাধারণ মানুষের জীবনেও এই আমদানির প্রভাব পড়ছে। চীন থেকে আসা সস্তা ইলেকট্রনিক পণ্যগুলো বাজারে প্রচুর পরিমাণে উপলব্ধ, যা ভারতীয় উৎপাদনকারীদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। তবে, এই সুযোগটাও ব্যবহার করে স্থানীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা সম্ভব, যদি সরকার সঠিক নীতি গ্রহণ করে। ভবিষ্যতে ভারতের জন্য এই নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা কতটা সফল হবে, তা সময়ের পরীক্ষায় ঝুলে থাকবে।