ভারতের কর ব্যবস্থা এক ঐতিহাসিক সংস্কারের সাক্ষী হতে চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকার শুক্রবার সরকারি গেজেটে আয়কর আইন, ২০২৫ (Income Tax Act, 2025) প্রকাশ করেছে। এর একদিন আগে, বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে বিলটি আইনে পরিণত হয়। এই নতুন আইন কার্যকর হবে ১ এপ্রিল, ২০২৬ থেকে, এবং এর মাধ্যমে বিদ্যমান আয়কর আইন, ১৯৬১-কে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করা হবে।
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নতুন আয়কর আইন একটি সরল, স্বচ্ছ ও করদাতা-বান্ধব কাঠামো গড়ে তুলবে। আয়কর দপ্তর এক্স (X)-এ পোস্ট করে লিখেছে— “আয়কর আইন, ২০২৫ রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেয়েছে। এটি দেশের প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনবে এবং করদাতাদের জন্য আরও সহজ ও কমপ্লায়েন্স-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করবে।”
১৯৬১ সালের আয়কর আইন দীর্ঘদিন ধরেই জটিলতা, ভাষাগত দুর্বোধ্যতা এবং অপ্রয়োজনীয় ধারার জন্য সমালোচিত হচ্ছিল। সেই আইন অনুযায়ী মোট ৮১৯টি ধারা ও ৪৭টি অধ্যায় ছিল। নতুন আইনে ধারা কমিয়ে আনা হয়েছে ৫৩৬টিতে এবং অধ্যায় রাখা হয়েছে মাত্র ২৩টি। এর ফলে আইনটি আরও সুনির্দিষ্ট ও সহজবোধ্য হয়েছে।
অধিকন্তু, ১৯৬১ সালের আইনে প্রায় ৫.১২ লক্ষ শব্দ ছিল, যা নতুন আইনে নেমে এসেছে ২.৬ লক্ষে। পাঠযোগ্যতা বাড়াতে প্রথমবারের মতো ৩৯টি নতুন টেবিল ও ৪০টি ফর্মুলা যুক্ত করা হয়েছে, যাতে দীর্ঘ ও জটিল টেক্সট এড়িয়ে তথ্য স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা যায়।
নতুন আয়কর বিলটি রেকর্ড সময়ে, মাত্র ছয় মাসে খসড়া করা হয়। ২০২৫ সালের বাজেট অধিবেশনে প্রথমবার এটি সংসদে উপস্থাপন করা হয় এবং বিস্তারিত পর্যালোচনার জন্য নির্বাচনী কমিটির (Select Committee) কাছে পাঠানো হয়।
কমিটির সুপারিশ পাওয়ার পর, সরকার আগের বিলটি প্রত্যাহার করে নেয় এবং সংশোধিত আয়কর (নং ২) বিল, ২০২৫ লোকসভায় পেশ করে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ১১ আগস্ট লোকসভায় বলেন— “কমিটির প্রায় সব সুপারিশই আমরা মেনে নিয়েছি। পাশাপাশি বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের মতামতও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে আইনের উদ্দেশ্য আরও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।”
কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ও সংশোধন:
১. ট্যাক্স রিফান্ড
পুরনো খসড়ায় বলা হয়েছিল, নির্দিষ্ট সময়সীমার পরে আয়কর রিটার্ন (ITR) দাখিল করলে কর ফেরত (refund) পাওয়া যাবে না। এই বিধানটি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। নতুন আইনে এই ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, এখন দেরিতে রিটার্ন দাখিল করলেও কর ফেরতের অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকবে।
২. আন্তঃকর্পোরেট লভ্যাংশে ছাড়
নতুন বিলের ধারা ১৪৮-এ পুনরায় যুক্ত করা হয়েছে সেকশন ৮০এম এর সুবিধা, যা আন্তঃকর্পোরেট ডিভিডেন্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এই সুবিধা বিশেষ ট্যাক্স রেট (সেকশন 115BAA) নেওয়া কোম্পানিগুলিও উপভোগ করতে পারবে।
৩. Nil TDS সার্টিফিকেট
করদাতারা এখন থেকে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে Nil TDS সার্টিফিকেট পেতে পারবেন। এর ফলে উৎসে কর কর্তন (TDS) এড়ানো সম্ভব হবে।
৪. গোপন অনুদান করমুক্তি
পুরোপুরি ধর্মীয় কাজে নিযুক্ত ট্রাস্টে দেওয়া অজ্ঞাত দাতা/অনামি অনুদান করমুক্ত থাকবে। তবে যারা ধর্মীয় কার্যক্রমের পাশাপাশি সামাজিক কাজ (যেমন স্কুল বা হাসপাতাল চালায়) করে, তাদের ক্ষেত্রে এই ছাড় প্রযোজ্য হবে না।
৫. ডিজিটাল-ফার্স্ট ট্যাক্স প্রক্রিয়া
পুরো আয়কর প্রক্রিয়াকে আরও ডিজিটাল, স্বয়ংক্রিয় ও ফেসলেস করা হচ্ছে। এর ফলে সুবিধা বাড়বে, এবং দুর্নীতির সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে।
গত মাসে মিডিয়ায় গুজব ছড়িয়েছিল যে নতুন আইনে ক্যাপিটাল গেইনস ট্যাক্সের হার পরিবর্তন হতে পারে। তবে আয়কর দপ্তর স্পষ্ট করে জানিয়েছে— এই বিলের উদ্দেশ্য শুধু ভাষা সরলীকরণ ও পুরনো ধারা বাতিল করা, করহারে কোনও পরিবর্তন আনা নয়।
নতুন আইন কার্যকর হওয়ার আগে আয়কর দপ্তরের কম্পিউটার সিস্টেম পুরোপুরি রিবুট করতে হবে। কারণ, ধারা, অধ্যায় ও প্রক্রিয়ার পরিবর্তনের কারণে সফটওয়্যার এবং ফাইলিং প্ল্যাটফর্মে বড়সড় আপডেট প্রয়োজন।
কর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সংস্কার ভারতের আয়কর ব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা করবে। সুস্পষ্ট ভাষা, টেবিল ও ফর্মুলা যুক্ত হওয়ায় সাধারণ করদাতাও সহজে আইন বুঝতে পারবেন। একইসঙ্গে দেরিতে রিটার্ন দাখিলের পরও রিফান্ড পাওয়া যাবে— এই বিধান সাধারণ করদাতাদের বড় সুবিধা দেবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই পদক্ষেপ সরকারের ডিজিটাল ইন্ডিয়া ও ইজ অব ডুয়িং বিজনেস মিশনকে আরও শক্তিশালী করবে।
১৯৬১ সালের আইন কার্যত সেকেলে হয়ে পড়েছিল। এখন ২০২৫ সালের নতুন আইন একটি সহজ, স্বচ্ছ ও আধুনিক ট্যাক্স কাঠামো তৈরি করতে চলেছে। আগামী ১ এপ্রিল, ২০২৬ থেকে কার্যকর হলে এটি নিঃসন্দেহে ভারতীয় কর ব্যবস্থার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে।