আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এর সাম্প্রতিক World Economic Outlook (WEO) রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে ৬.২ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। পূর্বের জানুয়ারি ২০২৫-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী এই হার ছিল ৬.৫ শতাংশ। আইএমএফ জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উত্তেজনা এবং অনিশ্চয়তা এই নিম্নমুখী সংশোধনের মূল কারণ।
আইএমএফ জানিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৫ শতাংশ, যা ২০২৬-২৭ সালে কমে ৬.২ শতাংশে নেমে আসবে। তবে রিপোর্টে আশার কথা বলা হয়েছে যে, ভারতের এই স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি আংশিকভাবে গ্রামীণ অঞ্চলের ব্যক্তিগত ভোগের ওপর নির্ভর করছে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চিত্রে আরও হতাশাজনক রূপ ফুটে উঠেছে রিপোর্টে। ২০২৫ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার ২.৮ শতাংশে নামবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, যা জানুয়ারির আপডেটের তুলনায় ০.৫ শতাংশ পয়েন্ট কম। ২০২৬ সালে এই হার সামান্য বাড়বে এবং দাঁড়াবে ৩ শতাংশে।
উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রবৃদ্ধি হ্রাসের ধারা লক্ষ করা গেছে। ২০২৪ সালে যেখানে এই হার ছিল ১.৮ শতাংশ, তা ২০২৫ সালে নেমে আসবে ১.৪ শতাংশে এবং ২০২৬ সালে সামান্য বেড়ে হবে ১.৫ শতাংশ। বিশেষ করে কানাডা, জাপান, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস নিচের দিকে সংশোধন করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ২০২৫ সালের প্রবৃদ্ধি ১.৮ শতাংশে নামবে বলে মনে করা হচ্ছে, যা ২০২৪ সালের চেয়ে ১ শতাংশ এবং জানুয়ারির পূর্বাভাস থেকে ০.৯ শতাংশ কম। এ হ্রাসের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বাণিজ্য উত্তেজনা এবং ভোক্তা ব্যয়ের ধীর গতি।
এদিকে, উদীয়মান ও উন্নয়নশীল এশিয়ার (বিশেষত আসিয়ান দেশগুলোর) অর্থনীতি ২০২৫ সালে ৪.৫ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে ৪.৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হয়েছে। এটি ২০২৪ সালের প্রবৃদ্ধির তুলনায় আরও কম। এই অঞ্চলের উপর এপ্রিল মাসে চালু হওয়া নতুন ট্যারিফগুলোর প্রভাব স্পষ্টভাবে পড়েছে।
চীনের অর্থনীতির ক্ষেত্রেও প্রবৃদ্ধি হ্রাসের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালে চীনের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৪.৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪.০ শতাংশ করা হয়েছে, এবং ২০২৬ সালেও এই হার ৪.০ শতাংশেই থাকবে বলে পূর্বাভাস। এর পেছনে মূলত নতুন আরোপিত ট্যারিফ এবং দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য অনিশ্চয়তাকে দায়ী করা হয়েছে।
আইএমএফের রিপোর্টে বলা হয়েছে, একাধিক অভূতপূর্ব এবং দীর্ঘস্থায়ী ধাক্কা সহ্য করার পরে বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন কিছুটা স্থিতিশীল হলেও, প্রবৃদ্ধির গতি এখনও আশানুরূপ নয়। সরকারের নীতিগত অগ্রাধিকারের রদবদল এবং বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
রিপোর্টে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে, “বাণিজ্য যুদ্ধ আরও তীব্র হলে এবং বাণিজ্য নীতিগত অনিশ্চয়তা বেড়ে গেলে, স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ঘাটতি বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।”
এই প্রেক্ষাপটে আইএমএফ সুপারিশ করেছে যে, দেশগুলো যেন গঠনমূলকভাবে কাজ করে একটি স্থিতিশীল ও পূর্বাভাসযোগ্য বাণিজ্য পরিবেশ গড়ে তোলে এবং ঘরোয়া অর্থনৈতিক কাঠামোগত দুর্বলতা চিহ্নিত করে তা সমাধানে উদ্যোগী হয়।
উল্লেখযোগ্যভাবে, প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার হ্রাসের বাস্তবতায় বৃদ্ধদের ও নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বাড়ানো, দক্ষতার ঘাটতি পূরণে অভিবাসী ও শরণার্থীদের অন্তর্ভুক্তিকরণসহ বিভিন্ন নীতিগত সংস্কারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও গ্রামীণ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী রাখা, এবং একইসঙ্গে বৈশ্বিক চাপ মোকাবিলায় কৌশলী কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা।
ভারত, যেহেতু বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম বড় ইঞ্জিন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, সেক্ষেত্রে তার স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি কেবল দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। এখন দেখার বিষয়, সরকার ও নীতি নির্ধারকেরা এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত।