কলকাতা, ১০ আগস্ট ২০২৫: দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক (ICICI Bank) সম্প্রতি একটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। ব্যাঙ্কটি আগামী ১ আগস্ট, ২০২৫ থেকে নতুন সেভিংস অ্যাকাউন্টে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা ব্যালেন্স রাখতে বাধ্যতামূলক করেছে। এই নিয়মটি মেট্রো এবং শহরতলি এলাকার গ্রাহকদের জন্য প্রযোজ্য হবে, যা পূর্বে ১০ হাজার টাকা থেকে পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন আয়ের গ্রাহকদের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
নতুন নিয়মের বিস্তারিত
ব্যাঙ্কের এই নতুন নীতি অনুযায়ী, মেট্রো এবং শহরতলি এলাকার নতুন অ্যাকাউন্টধারীদের প্রতি মাসে গড়ে ৫০ হাজার টাকা ব্যালেন্স রাখতে হবে। ঋণাত্মক এলাকায় এই পরিমাণটি ২৫ হাজার টাকা এবং গ্রামীণ এলাকায় ১০ হাজার টাকা নির্ধারিত হয়েছে, যা পূর্বে যথাক্রমে ৫ হাজার এবং ২,৫০০ টাকা ছিল। যদি কোনো গ্রাহক এই নির্ধারিত ব্যালেন্স রাখতে ব্যর্থ হন, তবে তাদের উপর ৬ শতাংশ জরিমানা বা ৫০০ টাকা, যেটি কম, আরোপ করা হবে। এই নিয়মটি শুধুমাত্র ১ আগস্ট, ২০২৫-এর পরে খোলা নতুন অ্যাকাউন্টগুলোর জন্য প্রযোজ্য, যদিও পুরনো গ্রাহকদের জন্য এখনো পুরনো নিয়মটিই কার্যকর রয়েছে।
গ্রাহকদের প্রতিক্রিয়া
এই সিদ্ধান্তের পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন ফোরামে গ্রাহকদের তীব্র প্রতিবাদ শোনা যাচ্ছে। অনেকে এই পদক্ষেপটিকে “অবাস্তব” এবং “মধ্যবিত্ত বিরোধী” বলে অভিহিত করেছেন। একজন গ্রাহক বলেন, “আমার মাসিক আয় ২০ হাজার টাকা, এখন কীভাবে ৫০ হাজার টাকা অ্যাকাউন্টে রাখব? এটা তো ব্যাঙ্কের লাভের জন্য আমাদের পকেট থেকে টাকা আদায়ের একটা চাল!” অন্যদিকে, কিছু গ্রাহক ইতিমধ্যে বিকল্প ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছেন, যেমন এসবিআই (SBI) যেখানে ২০২০ থেকে ন্যূনতম ব্যালেন্সের নিয়ম বাতিল করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও বিতর্ক
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই সিদ্ধান্ত ব্যাঙ্কের মুনাফা বৃদ্ধির জন্য নেওয়া হয়েছে, কারণ উচ্চ ব্যালেন্স রাখা গ্রাহকদের মাধ্যমে ব্যাঙ্ক পরিচালনা খরচ কমে এবং বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ে। তবে, এটি সামাজিক অসমতার বৃদ্ধি ঘটাতে পারে, বিশেষ করে যে দেশে ৯০% লোকের মাসিক আয় ২৭ হাজার টাকার কম। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (RBI) এর তথ্য অনুযায়ী, এই ধরনের নিয়ম নিম্ন আয়ের গ্রাহকদের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা থেকে দূরে সরিয়ে নেবে, যা ভারতের আর্থিক সামিলকরণের লক্ষ্যের বিপরীত।
১৯৬৯ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ১৪ ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের পর থেকে ব্যাঙ্কিং সেবা গ্রামীণ এবং নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য ছিল। তখন ন্যূনতম ব্যালেন্সের চাপ কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে ব্যক্তিগত ব্যাঙ্কগুলো এই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে বলে সমালোচকরা মন্তব্য করছেন। এই পদক্ষেপটি বাজারে “প্রিমিয়াম গ্রাহক” নির্দিষ্ট করে তাদের দিকে মনোযোগ দেওয়ার একটি কৌশল হতে পারে, তবে এটি সাধারণ মানুষের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করছে।
বিকল্প ব্যবস্থা
এই পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের জন্য কিছু বিকল্প রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জন ধন যোজনা (PMJDY) এর মাধ্যমে শূন্য ব্যালেন্সের অ্যাকাউন্ট খোলা সম্ভব, যা কোনো জরিমানা ছাড়াই চালিত হতে পারে। তবে এই অ্যাকাউন্টগুলোর সীমিত সুবিধা রয়েছে, যেমন কম ট্রানজাকশন সীমা। অন্যদিকে, এসবিআই এবং অন্যান্য পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলো কম ব্যালেন্সের সাথে অ্যাকাউন্ট পরিচালনার সুযোগ দেয়, যা গ্রাহকদের আকর্ষণ করতে পারে।
সরকার ও আরবিআই-এর ভূমিকা
আর্থিক সামিলকরণকে উৎসাহিত করার জন্য সরকার এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (RBI) বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যেমন জিরো ব্যালেন্স অ্যাকাউন্ট এবং ফিনান্সিয়াল লিটারেসি প্রোগ্রাম। তবে, ব্যক্তিগত ব্যাঙ্কগুলোর এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করে যে, তাদের লাভকাঙ্ক্ষী মানসিকতা সামিলকরণের লক্ষ্যকে প্রভাবিত করছে। গ্রাহকরা এখন সরকারের কাছ থেকে এই নিয়মের পুনর্বিবেচনা এবং বিকল্প ব্যবস্থার দাবি করছেন।