২০২৫-এ ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৯ শতাংশে, উদ্বেগ প্রকাশ HSBC-র

ভারতের আর্থিক ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে সম্প্রতি প্রকাশিত HSBC Global Research-এর একটি প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আনুষ্ঠানিক খাতে (formal sector) প্রবৃদ্ধির গতি ধীর…

Personal Loan, Interest Rates,Top Banks ,Low Interest Loans, India Personal Loans

ভারতের আর্থিক ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে সম্প্রতি প্রকাশিত HSBC Global Research-এর একটি প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আনুষ্ঠানিক খাতে (formal sector) প্রবৃদ্ধির গতি ধীর হওয়ায় দেশের সামগ্রিক ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধির হারেও স্পষ্ট পতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ভারতের ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধির হার যেখানে এক বছর আগে ছিল প্রায় ১৬ শতাংশ, তা নেমে এসেছে মাত্র ৯ শতাংশে। এই উল্লেখযোগ্য হ্রাস আর্থিক খাতে চাপ তৈরি করেছে এবং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক গতির উপরেও প্রভাব ফেলছে।

আনুষ্ঠানিক খাতের মন্থরতা:
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে শক্তিশালী ইকুইটি মার্কেট এবং বর্ধিত বেতন বৃদ্ধির ফলে আনুষ্ঠানিক খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এই দুই ক্ষেত্রেই একপ্রকার স্থিতিশীলতা এসেছে, যার ফলে নতুন বিনিয়োগের চাহিদা কমেছে এবং ঋণের প্রয়োজনীয়তাও হ্রাস পেয়েছে।
এখন দেশে এমন একটি অর্থনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, যেখানে বড় কর্পোরেট সংস্থা এবং শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাহিদা অনুপাতে ঋণের প্রয়োজন পড়ছে না। যেমন, আবাসন খাতে নতুন বিনিয়োগ কমে গেছে, কারণ গৃহঋণের জন্য চাহিদা হ্রাস পেয়েছে।

   

ঋণ চাহিদার দুই পাশ থেকেই চাপ:
HSBC-এর রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে ঋণ বৃদ্ধির গতি দুই দিক থেকেই চাপের মুখে পড়েছে। একদিকে আনুষ্ঠানিক খাতে বিনিয়োগ কমেছে, অন্যদিকে অনানুষ্ঠানিক খাতে (informal sector) আয় বৃদ্ধির ফলে ভোক্তা ঋণের চাহিদাও কমে গেছে। কৃষি ও গ্রামীণ খাতে আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ এখন নিজের খরচ চালাতে ঋণ না নিয়ে সঞ্চয় থেকে খরচ চালাতে পারছে।
সোজা ভাষায়, যেখানে শহরাঞ্চলের মানুষ এখন আর আগের মতো গৃহঋণ বা ব্যবসায়িক ঋণ নিচ্ছে না, সেখানে গ্রামীণ মানুষও আগের মতো ছোট ঋণ নিচ্ছে না তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটাতে।

বাস্তব অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত সংকট:
এই ঋণ বৃদ্ধির মন্থরতা কোনও হঠাৎ তৈরি হওয়া আর্থিক সংকট নয়, বরং এটি বাস্তব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাসেরই প্রতিফলন। আগেও যেমন আমানতের (deposit) ক্ষেত্রে প্রবণতা পরিবর্তনের পেছনে বাস্তব অর্থনীতির ভূমিকা ছিল, তেমনি এখন ঋণের ক্ষেত্রেও একই রকম চিত্র দেখা যাচ্ছে।

অর্থনীতির যে প্রবৃদ্ধি ছিল তা এখন ধীরে ধীরে স্থবির হচ্ছে এবং তারই ছায়া পড়ছে ব্যাংক ঋণের উপরে। একটি দিক থেকে এটি অর্থনীতির চাহিদা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

সম্ভাব্য সমাধান: সংস্কার এবং উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ:
HSBC-এর রিপোর্টের মতে, ভারত যদি সঠিক সংস্কারমুখী পদক্ষেপ নেয়, তাহলে এই মন্থরতা কাটিয়ে উঠা সম্ভব। বিশ্বজুড়ে যখন সাপ্লাই চেইন পুনর্গঠন হচ্ছে, তখন ভারতের সামনে রয়েছে বড় সুযোগ—একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা।

Advertisements

রিপোর্টে বলা হয়েছে, “যদি ভারত আমদানি শুল্ক হ্রাস করে, বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে, বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানায় এবং ব্যবসার পরিবেশকে সহজ করে তোলে, তাহলে দেশের উৎপাদন খাত জোরদার হবে। আর তা থেকে ঋণ চাহিদা, বিনিয়োগ এবং GDP প্রবৃদ্ধি—সবকিছুই আবার গতি পাবে।”

কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তবে দরকার গভীর সংস্কার:
যদিও কেন্দ্র সরকার ইতিমধ্যে কিছু সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করেছে—যেমন উৎপাদন সংক্রান্ত উৎসাহ প্রকল্প (PLI scheme), শ্রম আইন সংস্কার, পণ্য রপ্তানিতে উৎসাহ—তবু HSBC-এর মতে এই উদ্যোগগুলোকে আরও গভীর ও বিস্তৃতভাবে প্রয়োগ করতে হবে যাতে প্রকৃত প্রভাব ফেলে।

এই সংস্কার প্রক্রিয়াগুলি যদি শুধুমাত্র কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে তা দিয়ে ঋণ বৃদ্ধির বর্তমান সংকট বা অর্থনীতির গতি ধীর হওয়ার সমস্যার সমাধান হবে না।

ভারতের ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধির হ্রাস, যা এখন মাত্র ৯ শতাংশে এসে ঠেকেছে, সেটি সাময়িক কোনো ঘটনা নয় বরং বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রবণতার একটি অংশ। আনুষ্ঠানিক খাতের মন্থরতা এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের আয় বৃদ্ধি—এই দুটি বিপরীতমুখী ট্রেন্ড একসাথে দেশের ঋণ চাহিদা হ্রাস করছে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শুধু মুদ্রানীতির পরিবর্তন যথেষ্ট নয়; বরং প্রয়োজন গভীর ও কার্যকর অর্থনৈতিক সংস্কার। বিশ্ব বাণিজ্যের পুনর্গঠনের সময়কে কাজে লাগিয়ে ভারত যদি নিজেকে একটি শক্তিশালী উৎপাদন ভিত্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, তবেই ঋণ, বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি আবার আগের ছন্দে ফিরতে পারবে।