অবসর গ্রহণের পর জীবনের গতি কিছুটা ধীর হলেও, আর্থিক চাহিদা একেবারে ফুরিয়ে যায় না। চিকিৎসা, বাড়ির সংস্কার, ভ্রমণ বা পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহায়তা—এই সবকিছুই প্রবীণ নাগরিকদের জীবনের বাস্তবতা। কিন্তু নিয়মিত আয় না থাকার ফলে অনেক সময় প্রথাগত ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তবে বর্তমান সময়ে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি প্রবীণদের (Senior Citizens) জন্য নানা ধরনের বিশেষ ঋণ পরিষেবা চালু করেছে, যা তাঁদের অনিশ্চিত আর্থিক পরিস্থিতিকে কিছুটা স্থিতিশীল করতে সাহায্য করছে।
সোনার উপর ঋণ: দ্রুত, সহজলভ্য ও নমনীয়:
বাংলা পরিবারে বহু প্রবীণ নাগরিকের কাছেই সোনার অলংকার, মুদ্রা বা বার দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চিত থাকে। এই সোনাগুলি শুধু ঐতিহ্যের প্রতীক নয়, আর্থিক সংকটেও তা হতে পারে অত্যন্ত কার্যকর সম্পদ। বর্তমানে বহু ব্যাংক ও এনবিএফসি (NBFC) প্রবীণদের জন্য সোনার বিপরীতে দ্রুত ঋণ সুবিধা দিচ্ছে।
এই ঋণ পেতে প্রায় কোনো আয় প্রমাণপত্রের প্রয়োজন হয় না, যা অবসরপ্রাপ্ত বা নির্দিষ্ট আয়বিহীন ব্যক্তিদের জন্য আদর্শ। মাত্র কয়েকটি নথিপত্র জমা দিলেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঋণের টাকা হাতে পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুদের হার ব্যক্তিগত ঋণের তুলনায় কম, এবং পরিশোধের পদ্ধতিও নমনীয়—কেউ চাইলে মাসিক EMI, কেউ বা বুলেট পেমেন্ট অথবা আংশিক পরিশোধের সুবিধাও নিতে পারেন।
যেকোনো জরুরি অবস্থায়—যেমন হঠাৎ চিকিৎসার খরচ বা জরুরি ভ্রমণ—এই ঋণ হতে পারে তাৎক্ষণিক সমাধান।
আর্থিক সম্পদের বিপরীতে সুরক্ষিত ঋণ:
সোনার পাশাপাশি প্রবীণরা নিজেদের সঞ্চিত আর্থিক সম্পদ যেমন—ফিক্সড ডিপোজিট (FD), মিউচুয়াল ফান্ড, বা জীবনবিমা পলিসি ব্যবহার করেও সুরক্ষিত ঋণ নিতে পারেন। এসব সম্পদ জমা রেখে ব্যাংক বা NBFC থেকে ৬০% থেকে ৯০% পর্যন্ত ঋণ নেওয়া সম্ভব।
এই ঋণগুলি তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য, কারণ এতে সংস্থা ঝুঁকি কম মনে করে। পাশাপাশি, ফিক্সড ডিপোজিটের উপর সুদ চালু থাকে, অর্থাৎ ঋণের সময়েও সম্পদ থেকে কিছুটা আয় হতে থাকে।
চিকিৎসা, বাড়ির ছোটখাটো সংস্কার, অথবা নাতি-নাতনির পড়াশোনার খরচ—এই ধরনের মধ্যমেয়াদি খরচ মেটাতে এই ঋণ অত্যন্ত উপযোগী।
সন্তানের সঙ্গে যৌথ ঋণ নেওয়া: বড় ঋণের সহজ পথ:
বড় খরচ যেমন বাড়ির পুনর্গঠন, বড় অস্ত্রোপচার বা পারিবারিক অনুষ্ঠানের খরচ মেটাতে প্রবীণ নাগরিকরা তাঁদের কর্মরত সন্তানদের সঙ্গে যৌথ ঋণ নিতে পারেন। এতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়, সুদের হার কম হয় এবং পরিশোধের সময়সীমাও দীর্ঘ হয়।
একদিকে অবসরভাতা বা পেনশন, অন্যদিকে সন্তানের নিয়মিত বেতন—এই দুইয়ের সম্মিলিত আর্থিক ভিত্তি ব্যাংকের চোখে ঋণের নিরাপত্তা অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়।
এমন ব্যবস্থায় বাবা-মা ও সন্তানদের মধ্যে পারস্পরিক আর্থিক দায়িত্ববোধের সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। বর্তমানে বহু পরিবারে এই ব্যবস্থাকে আধুনিক যুগের ‘পারিবারিক অর্থনৈতিক কৌশল’ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
প্রবীণদের ঋণ ব্যবস্থাপনায় কিছু সতর্কতা:
১. ঋণের উদ্দেশ্য স্পষ্ট রাখুন: অপ্রয়োজনীয় বা অগুরুত্বপূর্ণ খরচের জন্য ঋণ না নেওয়াই ভাল।
২. বাজেট ও পরিশোধ ক্ষমতা বিবেচনা করুন: মাসিক EMI কতটা বহনযোগ্য তা যাচাই করে তবেই ঋণ নিন।
৩. চুক্তি ভালোভাবে পড়ুন: সুদের হার, দণ্ডমূল্য, চূড়ান্ত পরিশোধের শর্ত—সব ভালোভাবে জেনে তবেই ঋণ গ্রহণ করুন।
৪. বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান বেছে নিন: শুধুমাত্র RBI অনুমোদিত ব্যাংক ও NBFC-র মাধ্যমেই ঋণ নেওয়া নিরাপদ।
অবসর জীবন মানেই যে আর্থিকভাবে নির্ভরশীল হতে হবে, তা নয়। একটু সচেতন পরিকল্পনা ও সঠিক ঋণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রবীণ নাগরিকরাও তাঁদের চাহিদা পূরণ করতে পারেন স্বনির্ভরভাবে। সোনা, ফিক্সড ডিপোজিট, জীবনবিমা বা সন্তানের সহযোগিতা—সব মিলিয়ে ঋণের এই আধুনিক ব্যবস্থাপনা প্রবীণদের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
সাবধানতা ও দায়িত্বশীলতা বজায় রেখে ঋণ গ্রহণ করলে, অবসরকালীন জীবনও হতে পারে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ।