ভারতের অর্থনীতি যেন ‘গোদোর অপেক্ষা’— বারবার আশার আলো দেখা গেলেও সেই বহুল প্রত্যাশিত উচ্চতর প্রবৃদ্ধি এখনও অধরা। সরকারও স্বীকার করে যে ‘অবস্থা ভালো হলেও আরও ভালো হওয়া উচিত’। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির বাজেটে ট্যাক্স রিবেট ঘোষণা কিংবা স্বাধীনতা দিবসে জিএসটি সংস্কারের ঘোষণা অর্থনীতিকে প্রণোদনা দেওয়ার চেষ্টা হলেও এগুলো এককালীন সুবিধা। অথচ সরকারের হাতে রয়েছে এক দীর্ঘস্থায়ী ‘অস্ত্র’— যা একবার কার্যকর হলে অবিরাম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্রোত বইতে পারে।
এই প্রসঙ্গে মূল আলোচ্য বিষয় হলো এনআরআইদের (NRI ) ট্যাক্স রেসিডেন্সি নিয়ম। ২০২১ সাল থেকে ভারত সরকার ‘অ-নিবাসী’ (Non-Resident) হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার শর্ত বদল করে। আগে অর্থবর্ষে ১৮২ দিনের কম সময় ভারতে থাকলেই কেউ এনআরআই হিসেবে গণ্য হতেন। কোভিডের সময় থেকে সেই দিনসংখ্যা কমিয়ে আনা হয় ১২০ দিনে।
সরকারের উদ্দেশ্য ছিল ধনী ভারতীয়রা যাতে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে সহজে সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ে ছয় মাস থেকে আবার ভারতে এসে ছয় মাস না কাটাতে পারেন। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। যারা আগে ভারতে ছয় মাস কাটাতেন, তারা বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ৬০ দিন বিদেশে কাটাচ্ছেন— ফলে তাদের জীবনযাত্রার খরচ বিদেশেই হচ্ছে, ভারতের জিডিপি তাতে ক্ষতিগ্রস্ত। অনেকেই স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যাচ্ছেন।
এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। প্রায় ৪ কোটি এনআরআই কোভিডের পর থেকে পাঁচ বছর বয়স্ক হয়েছেন এবং তাদের সম্পদও বহুগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনআরআইরা সবচেয়ে ধনী এবং তাদের সংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই অবসরপ্রাপ্ত এবং পরিবার-আত্মীয়দের কাছে থাকার জন্য ভারতে বেশি সময় কাটাতে চান।
গণনায় ধরা যাক— যদি ৪০% অর্থাৎ ১৬ লক্ষ এনআরআই অবসরপ্রাপ্ত বয়সের হয় এবং তাদের মধ্যে ২০% ভারতে ছয় মাস থাকতে চান, তবে দাঁড়ায় প্রায় ৩.২ লক্ষ এনআরআই। পরিবার ধরে নিলে প্রায় ১.৬ লক্ষ পরিবার প্রতিবছর ভারতে অর্ধেক সময় কাটাবেন।
প্রতি পরিবার যদি মাসে গড়ে ৪ লক্ষ টাকা খরচ করেন, তবে ছয় মাসে খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৩৭,০০০ কোটি টাকা বা ৪.২ বিলিয়ন ডলার। এর অন্তত ২৫-৩২% ভাড়া বাবদ এবং বাকিটা খাবার, কেনাকাটা, স্বাস্থ্যসেবা ও বিভিন্ন সেবায় ব্যয় হবে। অবসরপ্রাপ্ত এই পরিবারের খরচের মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্ট বা গুণিতক প্রভাব ৫ গুণ— অর্থাৎ এই ৩৭,০০০ কোটি টাকার খরচ আসলে প্রায় ১.৮৫ লক্ষ কোটি টাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তৈরি করতে পারে। ভারতের জিডিপি বৃদ্ধিতে বছরে অন্তত ০.৭% স্থায়ী সংযোজন হবে।
একসময় ইনফোসিস বা টিসিএস বছরে ১৫-২০ হাজার নতুন কর্মী নিয়োগ করত। প্রতিটি তরুণ কর্মীর ব্যয় অর্থনীতিতে বহুগুণ সঞ্চালন করত। অর্থনীতিবিদরা হিসাব করেছিলেন, একজন কর্মীর প্রতি ১ টাকার খরচ আসলে ৫ টাকার কর্মকাণ্ড সৃষ্টি করে। এখনকার প্রেক্ষাপটে বলা যায়, এই প্রস্তাবিত এনআরআই খরচ ভারতে ৮ লক্ষ নতুন চাকরি সৃষ্টির সমান প্রভাব ফেলতে পারে— অথচ সরকারের একটিও টাকা ভর্তুকি দিতে হবে না।
এখানে উদাহরণ হতে পারে কানাডার অবসরপ্রাপ্তদের ‘স্নোবার্ড’ মডেল। প্রতি শীতেই কয়েক লক্ষ কানাডিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, টেক্সাস বা অ্যারিজোনায় চলে যান ছয় মাসের জন্য। ২০২৪ সালে প্রায় ৩০ লক্ষ কানাডিয়ান যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন। শুধু তাই নয়, তারা স্থানীয় অর্থনীতিতে স্থায়ী অবদান রাখেন— সম্পত্তি কেনেন, কর দেন।
ভারত যদি একইভাবে অবসরপ্রাপ্ত এনআরআইদের ছয় মাস থাকার ট্যাক্স-সহজ নিয়ম দেয়, তবে তারা শুধু খরচই করবেন না, বরং দীর্ঘমেয়াদে ভারতের আবাসন, স্বাস্থ্য, ভোগ্যপণ্য, পর্যটন ও পরিষেবা খাতে জোয়ার আনবেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারকে উচিত হবে আবার ১৮২ দিনের নিয়ম ফিরিয়ে আনা। পাশাপাশি “Resident but Not Ordinarily Resident (RNOR)” এর জটিল শর্ত বাদ দিয়ে সহজ করা দরকার। এতে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপ, কানাডা, সিঙ্গাপুর-সহ বিশ্বজুড়ে থাকা ধনী ও অবসরপ্রাপ্ত এনআরআইরা স্বেচ্ছায় ভারতে আসবেন।
এতে সরকারের কোনও সরাসরি খরচ নেই। বরং অতিরিক্ত জিএসটি ও ভোগ কর বাবদ রাজস্ব বাড়বে। দীর্ঘমেয়াদে এই খরচ ও বিনিয়োগ ভারতে স্থায়ী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তি গড়ে তুলবে।
ভারতের জন্য এনআরআই নীতি কেবল প্রবাসীদের নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ইঞ্জিন হতে পারে। ‘হাউডি মোদি’ ইভেন্টে যে এনআরআই আবেগ দেখা যায়, সেটিকে অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করার এটাই সঠিক সময়। স্রেফ ১২০ দিন থেকে ১৮২ দিনে ফেরা ভারতীয় অর্থনীতির জন্য হতে পারে গেমচেঞ্জার— যা প্রতি বছর অব্যাহতভাবে জিডিপি বাড়াবে এবং এক নতুন New Resurgent India গড়ার পথে নেতৃত্ব দেবে।