চিকিৎসার পরও অর্থের চিন্তা? জেনে নিন বিশেষ আর্থিক পরিকল্পনা

যখনই আমরা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আর্থিক ঝুঁকির (Hospitalization Expenses) কথা বলি, প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে হাসপাতালের খরচ — ভর্তি ফি, সার্জারি, ডায়াগনস্টিক টেস্ট, ওষুধপত্র ইত্যাদি। এই…

Non-Hospitalization Expenses In Critical Illnesses

যখনই আমরা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আর্থিক ঝুঁকির (Hospitalization Expenses) কথা বলি, প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে হাসপাতালের খরচ — ভর্তি ফি, সার্জারি, ডায়াগনস্টিক টেস্ট, ওষুধপত্র ইত্যাদি। এই খরচগুলো সত্যিই বিশাল। কিন্তু বাস্তবে এই দৃশ্যমান খরচগুলোই হলো শুধুমাত্র পুরো আর্থিক চাপের একটি অংশ। এর বাইরেও রয়েছে এমন অনেক খরচ, যা অপ্রত্যাশিত, পরিকল্পনার বাইরে এবং অধিকাংশ সময় বীমার অন্তর্ভুক্ত নয়।

ক্যানসার, হৃদরোগ বা স্নায়ুজনিত জটিল রোগের মতো গুরুতর অসুখের চিকিৎসার জন্য অনেক সময় স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে রোগীকে মেট্রোপলিটন শহর বা বিদেশে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা করাতে হয়। আর এই চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত হয় অনেক ancillary খরচ — বিমান বা ট্রেনের টিকিট, অস্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা, পরিবারের লোকজনের থাকা-খাওয়ার খরচ, স্থানীয় পরিবহন, এবং অন্যান্য লজিস্টিকাল ব্যয়। এগুলো সরাসরি চিকিৎসার মধ্যে না পড়লেও, কার্যকর চিকিৎসা সম্পন্ন করতে এগুলো অপরিহার্য।

   

শুধু লজিস্টিক খরচই নয়, গুরুতর অসুখের মানসিক ও শারীরিক প্রভাবের জন্য পরিবারের সদস্যদের কর্মজীবনেও বড় ধাক্কা আসে। রোগীর সেবায় নিয়োজিত স্বজনদের অনেক সময় কাজ থেকে দীর্ঘ ছুটি নিতে হয়। যদি রোগী নিজেই পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী হন, তাহলে চিকিৎসা ও পুনরুদ্ধারের সময় আয়ের ঘাটতি পরিবারের আর্থিক স্থিতি পুরোপুরি ভেঙে দিতে পারে। পাইলট, সার্জন, বা উদ্যোক্তার মতো উচ্চ-নির্ভরশীল পেশার মানুষরা অনেক সময় দীর্ঘ সময়ের জন্য কর্মে ফিরতে পারেন না, যা আয় বন্ধের ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

চিত্রটি স্পষ্ট করতে, একটি উদাহরণ ধরা যাক — হৃদযন্ত্রের কোনো বড় সার্জারির জন্য হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসার খরচ প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে, যা অধিকাংশ সাধারণ স্বাস্থ্য বীমায় কাভার থাকে। কিন্তু যদি রোগীকে অন্য শহরে যেতে হয়, তখন থাকা-খাওয়া, যাতায়াত এবং আনুষঙ্গিক খরচ মিলে প্রায় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা বা তার বেশি হতে পারে। এর পাশাপাশি, যদি রোগীর বা পরিবারের উপার্জন বন্ধ থাকে কয়েক মাসের জন্য, তাহলে সেই সুযোগের খরচও কয়েক লাখ টাকার সমান হতে পারে, যা কোনো সাধারণ স্বাস্থ্য বীমা কভার করে না।

এখানেই মূল সমস্যা। প্রচলিত স্বাস্থ্য বীমা যেখানে সরাসরি চিকিৎসার খরচকে কভার করে, সেখানে এই ‘নন-মেডিক্যাল’ খরচগুলো রোগীর ও পরিবারের ওপরেই বর্তায়। এই ফাঁক পূরণ করতে, বাজারে ‘ক্রাইসিস কভার’ বা ‘ক্রিটিকাল ইলনেস কভার’ নামে নতুন বীমা পরিকল্পনা আসছে। এই ধরনের প্ল্যানে নির্দিষ্ট কিছু গুরুতর রোগ নির্ণয় হওয়ার পরই এককালীন লাম্প-সাম অর্থ দেওয়া হয়। বিশেষত্ব হলো, এই অর্থ কোনো নির্দিষ্ট খাতে খরচ করার শর্ত থাকে না। ফলে এই অর্থ দিয়ে থাকা-খাওয়ার খরচ, বাড়তি চিকিৎসার ব্যবস্থা, আয়ের অভাব পূরণ, এমনকি দৈনন্দিন পরিবারের খরচ চালানো পর্যন্ত সবই করা যায়।

Advertisements

বর্তমান সময়ে স্বাস্থ্য সমস্যা আগের তুলনায় অনেক জটিল। কেবলমাত্র প্রচলিত স্বাস্থ্য বীমা দিয়ে পুরো ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। ক্রাইসিস কভার এই ফাঁক পূরণ করতে অত্যন্ত কার্যকর। এটি পরিবারের আর্থিক স্থিতি রক্ষার পাশাপাশি রোগী এবং তার স্বজনদের মানসিক শান্তিও নিশ্চিত করে।

একটি গুরুতর রোগের সময় রোগী ও পরিবারের একমাত্র মনোযোগ থাকা উচিত চিকিৎসা ও দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা নিয়ে। অথচ প্রায়ই দেখা যায়, অর্থের চিন্তা চিকিৎসার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে। ক্রাইসিস কভার সেই চাপ কমিয়ে দেয়, কারণ এককালীন অর্থ সাহায্য হাতে থাকায় পরিবার নিজেদের মতো করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিটি পরিবারকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করার সময় শুধু হাসপাতালের খরচ নয়, চিকিৎসার পরবর্তী সময়ের খরচ, বাড়তি আয়ের প্রয়োজন এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় হিসেব করে চলা উচিত। ক্রাইসিস কভার বেছে নিলে পরিবার আর্থিক দিক থেকে আরও নিরাপদ থাকতে পারে।

আজকের দিনে যখন জীবন অনিশ্চয়তা ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভরা, তখন একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য সুরক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করা শুধু বুদ্ধিমানের কাজ নয়, অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। চিকিৎসার মান উন্নত করতে এবং আর্থিক সুরক্ষায় আত্মনির্ভর হতে, রোগ নির্ণয়ের পর লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য যথাযথ অর্থের জোগান নিশ্চিত করাই আসল লক্ষ্য। তাই, স্বাস্থ্য বীমা এবং ক্রাইসিস কভার — এই দুইয়ের সমন্বয়েই গড়ে উঠতে পারে একটি সঠিক আর্থিক সুরক্ষার দেয়াল।