দেশের হ্যান্ডলুম শিল্পে (Handloom Sector) নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে গত পাঁচ বছরে ১,৪৮০.৭১ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ২০২০-২১ থেকে ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে এই অর্থ জাতীয় হ্যান্ডলুম উন্নয়ন কর্মসূচি (National Handloom Development Programme – NHDP) এবং কাঁচামাল সরবরাহ প্রকল্প (Raw Material Supply Scheme – RMSS)–এর আওতায় বিতরণ করা হয়েছে। এই তথ্য রাজ্যসভার এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী গিরিরাজ সিংহ।
মন্ত্রী জানান, ২০১৯-২০ সালের চতুর্থ অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডলুম সেন্সাস অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৩১.৪৫ লক্ষ হ্যান্ডলুম কটেজ ইউনিট সক্রিয় রয়েছে। এই ইউনিটগুলিতে মোট ৩৫,২২,৫১২ জন হ্যান্ডলুম বুনন ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যুক্ত কর্মী রয়েছেন। যার মধ্যে ৯,৭৫,৭৩৩ জন পুরুষ, ২৫,৪৬,২৮৫ জন মহিলা এবং ৪৯৪ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছেন।
মন্ত্রী স্পষ্ট জানান, হ্যান্ডলুম খাতটি মূলত অসংগঠিত। এখানে সরকার সরাসরি কর্মসংস্থান প্রদান করে না। বরং ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পে নিযুক্ত এই কর্মীরা নিজেরাই স্বনির্ভরভাবে কাজ করে থাকেন। তবে সরকার বিভিন্ন স্কিমের মাধ্যমে তাঁদের পাশে থাকার চেষ্টা করে।
হ্যান্ডলুম শিল্পের উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগ:
বর্তমানে বস্ত্র মন্ত্রক দুটি বড় প্রকল্প – NHDP এবং RMSS – রূপায়ণ করছে। এই প্রকল্পগুলির মূল লক্ষ্য হল হ্যান্ডলুম শিল্পকে টিকিয়ে রাখা ও বুনকারদের জীবনমান উন্নত করা।
এই প্রকল্পগুলির মাধ্যমে যা কিছু সহায়তা দেওয়া হয় তার মধ্যে রয়েছে:
উন্নত মানের করঘর (loom) ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি কেনার জন্য আর্থিক সহায়তা
কাঁচামাল সংগ্রহে ভর্তুকি
সৌরবিদ্যুৎ চালিত আলোর ব্যবস্থা
বুনকারদের কর্মশালা নির্মাণ
ডিজাইন উন্নয়ন, পণ্যের বৈচিত্র্য এবং বাজারজাতকরণে সহায়তা
প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা
Weavers’ MUDRA স্কিমের মাধ্যমে স্বল্পসুদের ঋণ
বয়স্ক বা অসুস্থ বুনকারদের আর্থিক সহায়তা
সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা
মন্ত্রী জানান, এই দুটি প্রকল্পের জন্য ৫ বছরে মোট ১,৫১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১,৪৮০.৭১ কোটি টাকা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পর্যায়ে বণ্টন করা হয়েছে।
পর্যালোচনার মাধ্যমে নতুন প্রকল্প রূপায়ণ:
রাজ্যসভায় গিরিরাজ সিংহ বলেন, সরকার কোনো নতুন প্রকল্প রূপায়ণের আগে বা পুরনো প্রকল্প চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার প্রভাব বিশ্লেষণ করে। NHDP ও RMSS – এই দুটি প্রকল্পও পূর্ববর্তী প্রকল্পের তৃতীয় পক্ষের মূল্যায়নের ভিত্তিতে ২০২১-২২ থেকে ২০২৫-২৬ সালের জন্য কার্যকর করা হয়েছে।
নারীশক্তির প্রধান ভূমিকা:
হ্যান্ডলুম শিল্পে নারীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চতুর্থ অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডলুম সেন্সাস ২০১৯-২০ অনুযায়ী, মোট হ্যান্ডলুম কর্মীর মধ্যে ৭২% (২৫,৪৬,২৮৫ জন) হলেন মহিলা। এটি প্রমাণ করে যে, এই খাতে মহিলারা কতটা সক্রিয় এবং তাঁদের আর্থিক স্বনির্ভরতায় হ্যান্ডলুম শিল্প কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ও চ্যালেঞ্জ:
ভারতের হ্যান্ডলুম শিল্পে আঞ্চলিক বৈচিত্র্য স্পষ্ট। অসম, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ, কর্ণাটক, কেরল, মণিপুর প্রভৃতি রাজ্যে এই শিল্পের গভীর প্রভাব রয়েছে। তবে প্রতিযোগিতামূলক বাজার, আধুনিক মেশিনভিত্তিক টেক্সটাইল ইউনিটগুলির প্রভাব, কাঁচামালের দাম, ও বাজারের অভাব ইত্যাদি কারণে আজও বহু হ্যান্ডলুম ইউনিট টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত।
সরকারের আর্থিক সহায়তা এবং নীতিগত উদ্যোগ সত্ত্বেও, দেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী হ্যান্ডলুম শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে গেলে আরও কার্যকর পরিকল্পনা, প্রযুক্তিগত হস্তক্ষেপ এবং বাজারসৃষ্টির উপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি, বুনকারদের সামাজিক ও আর্থিক সুরক্ষার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি।
দেশের ৩১.৪৫ লক্ষ হ্যান্ডলুম ইউনিট কেবল এক একটি শিল্প কেন্দ্র নয়, বরং এক একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বাহক। তাই এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে ও নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করতে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণও প্রয়োজন।