ভারতের জিএসটি কাঠামোয় (GST) আসতে চলেছে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন। জিএসটি রেট র্যাশনালাইজেশন নিয়ে গঠিত গ্রুপ অব মিনিস্টার্স (GoM) কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যে সুপারিশ জমা দিয়েছে, তা কার্যকর হলে দেশের ট্যাক্স ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। সূত্রের খবর, এবার ১২% ও ২৮% স্ল্যাব সম্পূর্ণ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। এর বদলে নতুন করে খাতভিত্তিক পুনর্বিন্যাস করা হবে করহার।
কেন্দ্রের দাবি, এই সংস্কারের লক্ষ্য মূলত কর-সংগ্রহ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করা। পাশাপাশি, শিল্প জগতে এক জটিল ট্যাক্স কাঠামোকে সহজ করে তুলতেই এই পদক্ষেপ। আগামী ২ থেকে ৪ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত জিএসটি কাউন্সিল বৈঠকে এই প্রস্তাবগুলিই আলোচনার টেবিলে উঠতে চলেছে।
Also Read | Creta-কে টেক্কা দিতে প্রতিদ্বন্দ্বী আনছে Maruti Suzuki, টিজার ঘিরে তুমুল চর্চা
সবচেয়ে আলোচনার বিষয় হল অটোমোবাইল এবং অটো অ্যাঙ্কিলারি শিল্প। বর্তমানে এই খাতে জিএসটি হার ২৮%। প্রস্তাবিত সংস্কারে তা নামিয়ে আনা হতে পারে ১৮%-এ। এর ফলে গাড়ির দাম কিছুটা হলেও কমতে পারে, যা সরাসরি গ্রাহকদের উপকারে আসবে। একইসঙ্গে, ধাক্কা খাওয়া অটো ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা ফের ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা।
সার শিল্পের উপরেও বিশেষ নজর দিয়েছে সরকার। বর্তমানে ফার্টিলাইজার অ্যাসিডে ১৮% এবং বায়ো-পেস্টিসাইডে ১২% জিএসটি বসে। নতুন প্রস্তাবে তা একেবারে নামিয়ে আনা হচ্ছে ৫%-এ। কৃষক ও কৃষিনির্ভর শিল্পের জন্য এটি একটি বড় স্বস্তি হবে। সার উৎপাদনের খরচ কমলে তার প্রভাব সরাসরি মাঠ পর্যায়ে পৌঁছাবে।
যদিও সব খাতের জন্য সুখবর থাকছে না। কয়লা, ব্রিকেটস, লিগনাইট এবং পিট থেকে তৈরি অন্যান্য জ্বালানি পণ্যে জিএসটি ৫% থেকে বাড়িয়ে এক লাফে ১৮% করার প্রস্তাব রয়েছে। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়তে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এটি এক ধরনের ‘রেভিনিউ ফোকাসড’ পদক্ষেপ।
পরিবেশবান্ধব খাতে অবশ্য সরকারের প্রণোদনা অব্যাহত। সোলার কুকার, সোলার ওয়াটার হিটার এবং অন্যান্য গ্রিন এনার্জি ডিভাইসে করহার ১২% থেকে কমিয়ে ৫% করার প্রস্তাব আছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
বড় সুবিধা পেতে চলেছে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি। সিনথেটিক ফিলামেন্ট ইয়ার্ন, ম্যানমেড স্ট্যাপল ফাইবার ইয়ার্ন, সুতো, কার্পেট, গজ, রাবার থ্রেড—এসব গুরুত্বপূর্ণ টেক্সটাইল সামগ্রীতে জিএসটি হার ১২% থেকে নামিয়ে ৫% করার পরিকল্পনা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই এই খাত কর কমানোর দাবি জানিয়ে আসছিল। এবার সেই দাবি পূরণের পথে কেন্দ্র।
রেডিমেড পোশাকের জন্য নতুন প্রস্তাবে একদিকে যেমন সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে, তেমনি উচ্চ মূল্যের পোশাকে কর বাড়তে চলেছে। বর্তমানে ১,০০০ টাকার নিচের পোশাকে জিএসটি হার ৫%। এবার সেই সীমা বাড়িয়ে ২,৫০০ টাকা পর্যন্ত করা হচ্ছে। তবে ২,৫০০ টাকার উপরের পোশাকে করহার বাড়বে—১২% থেকে সরাসরি ১৮%।
ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রেও একই নিয়ম কার্যকর হবে। ২,৫০০ টাকার নিচের জুতোয় জিএসটি হার ১২% থেকে কমিয়ে ৫% করা হবে। কিন্তু দামি জুতোর ক্ষেত্রে করহার বাড়বে—১২% থেকে ১৮%। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য স্বস্তি হলেও, প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের পণ্যে ক্রেতাদের বেশি খরচ করতে হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই সংস্কার বাস্তবায়িত হলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উপর সরাসরি প্রভাব পড়বে। গাড়ি, সার, টেক্সটাইল, নবায়নযোগ্য শক্তির মতো খাতে খরচ কমায় স্বস্তি মিললেও, কয়লা এবং প্রিমিয়াম পোশাক-জুতোর ক্ষেত্রে খরচ বাড়বে।
অন্যদিকে, রাজস্বের দিক থেকেও কেন্দ্রীয় সরকারের লাভ হতে পারে। কয়লা খাতে করহার বৃদ্ধি সরকারের রাজস্ব ভান্ডার পূরণ করবে। একইসঙ্গে, কৃষি ও সবুজ শক্তিতে করছাড় দীর্ঘমেয়াদে গ্রোথকে ত্বরান্বিত করবে।
তবে সবই এখন প্রস্তাব মাত্র। আগামী ২ থেকে ৪ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত জিএসটি কাউন্সিল বৈঠকে এই বিষয়গুলি বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। বৈঠক শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে তা কার্যকর হতে পারে চলতি আর্থিক বছরের মধ্যেই।
এই প্রস্তাব স্পষ্ট করে দিচ্ছে, কেন্দ্র একদিকে যেমন রাজস্ব বৃদ্ধির দিকে নজর রাখছে, অন্যদিকে ট্যাক্সের জটিলতা কমাতে চাইছে। খাতভিত্তিক পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে একদিকে কৃষক, সাধারণ ভোক্তা ও মাঝারি শিল্পকে স্বস্তি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, আবার কয়লা ও প্রিমিয়াম খাতে কর বাড়িয়ে রাজস্ব ক্ষতিও সামাল দেওয়ার কৌশল নেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে, জিএসটি কাঠামোয় আসন্ন এই পরিবর্তন দেশের করব্যবস্থায় নতুন এক অধ্যায় খুলে দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে।