ভারতের প্রস্তাবিত পণ্য ও পরিষেবা কর (GST ) সংস্কার এবার দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন গতি আনতে চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকার সূত্রে জানা গিয়েছে, আসন্ন এই সংস্কারের ফলে রপ্তানিকারকদের জন্য রিফান্ড প্রক্রিয়া বহুগুণ দ্রুত হবে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলির (এমএসএমই) জন্য কমপ্লায়েন্স অনেক সহজ হবে এবং একই সঙ্গে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও কমবে।
সরকারি এক শীর্ষকর্তা শনিবার জানান, “নতুন ব্যবস্থায় রিফান্ডের প্রায় ৯০ শতাংশ খুব দ্রুত, মাত্র দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই ইস্যু করা হবে। এতে সব করদাতার সুবিধা হবে, তবে রপ্তানিকারকরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন।”
বর্তমানে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিশেষত মার্কিন প্রশাসন ভারতের রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি বাণিজ্যে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত শুল্ক বসিয়েছে, যা রপ্তানিকারকদের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতেই ভারত সরকার দ্রুত রিফান্ড ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যবসার নগদ প্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
রিফান্ড সমস্যা কেবল রপ্তানিতে নয়, দেশীয় অনেক শিল্পক্ষেত্রেও প্রকট। যেমন সার ও টেক্সটাইল খাতে, যেখানে কাঁচামালের উপর উচ্চ হারে কর ধার্য হয়, কিন্তু প্রস্তুত পণ্যের উপর কর তুলনামূলকভাবে কম। একে বলা হয় “ইনভার্টেড ডিউটি স্ট্রাকচার”। নতুন সংস্কারের মাধ্যমে এই ধরনের বৈষম্যও কমানো হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্র।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুক্রবার ঘোষণা করেছেন, আসন্ন উৎসবের মরশুমেই তাঁর সরকার জিএসটি সংস্কার কার্যকর করবে। এর আওতায় ১২% এবং ২৮% করের হার বাতিল করে অধিকাংশ পণ্যকে ৫% এবং ১৮% হারে ট্যাক্সের আওতায় আনা হবে। এতে একদিকে মূল্য স্থিতিশীলতা আসবে, অন্যদিকে শ্রেণিবিন্যাসজনিত মামলাও অনেক কমবে।
সরকারি সূত্রে আরও জানানো হয়েছে, পাস্তা, জ্যাম, নোনতা নাশতার মতো মধ্যবিত্তের ব্যবহার্য খাদ্যপণ্যের দামও নতুন হারে কমে আসতে পারে।
দেশের অর্থনীতির অন্যতম মেরুদণ্ড মাইক্রো, স্মল ও মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজেস (এমএসএমই)। এদের জন্য রেজিস্ট্রেশন ও রিটার্ন ফাইলিং প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করা হচ্ছে। এক সরকারি আধিকারিক বলেন, “নতুন ব্যবস্থায় রেজিস্ট্রেশন সর্বাধিক তিন দিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে। কমপ্লায়েন্স সহজ হলে ছোট ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিকভাবেই লাভবান হবেন।”
সংস্কারের ফলে স্বল্পমেয়াদে রাজস্ব আয় কিছুটা কমতে পারে। তবে কেন্দ্রের আশাবাদ, খরচ বৃদ্ধি ও কর ফাঁকি কমার ফলে সেই ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে। ফলে সামগ্রিকভাবে এই কর সংস্কার রাজস্ব কাঠামোকে টেকসই রাখবে।
বর্তমানে তামাক, গাড়ি ও কার্বনেটেড ড্রিঙ্কসের মতো পণ্যের উপর জিএসটি ক্ষতিপূরণ সেস ধার্য রয়েছে। এই অর্থ দিয়ে কেন্দ্র রাজ্যগুলিকে ঋণ সহায়তা দিয়েছিল কোভিড মহামারির সময়। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, মহামারির সময় ২.৬৯ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ তোলা হয়েছিল। ২০২৬-এর মার্চের মধ্যেই সেই ঋণ ও সুদ পরিশোধ হয়ে যাবে। ফলে তার আগেই সেস উঠিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশাবাদী সরকার।
নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, “পাপজাতীয় পণ্য” যেমন তামাকের উপর প্রায় ৪০% হারে কর ধার্য করা হতে পারে। অন্যদিকে সেসের হার বর্তমানে ১% থেকে শুরু করে ধূমপানের মিশ্রণে ব্যবহৃত উপকরণের ক্ষেত্রে ২৯০% পর্যন্ত রয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ভারতের এই জিএসটি সংস্কার শুধু কর কাঠামো সরলীকরণের জন্য নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্যও জরুরি। করের হার কমলে এবং পণ্যের দাম সস্তা হলে ভোগ বৃদ্ধি পাবে, যা দীর্ঘমেয়াদে শিল্পোন্নয়নে সহায়ক হবে।
বর্তমানে বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী সম্রাট চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল মন্ত্রী এই প্রস্তাব খতিয়ে দেখছেন। তাদের রিপোর্ট পাওয়ার পর জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠক ডাকা হবে এবং তারপরেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে।
ব্যবসায়ী সংগঠন ও শিল্পমহল দীর্ঘদিন ধরেই জিএসটি সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছিল। বিশেষত জটিল করহার, ঘন ঘন শ্রেণিবিন্যাসের বিরোধ, রিফান্ডে দেরি ও ইনভার্টেড ডিউটি স্ট্রাকচারের সমস্যা দূর করার প্রয়োজনীয়তার কথা শিল্পমহল বারবার জানিয়েছে। এবার সেই দাবিই বাস্তবায়িত হতে চলেছে।
সব মিলিয়ে, ভারত সরকারের এই উদ্যোগ একদিকে যেমন রপ্তানিকারক ও এমএসএমই খাতকে স্বস্তি দেবে, অন্যদিকে সাধারণ ভোক্তাদেরও দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় পণ্য কিছুটা সস্তায় মিলবে। রাজস্ব আয়ে সাময়িক ধাক্কা লাগলেও ভোগ ও উৎপাদন বাড়ার ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির গতি বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।