ভারত সরকারের প্রস্তাবিত পণ্য ও পরিষেবা কর (GST) কাঠামোর বড় পরিবর্তন ভোক্তাদের জন্য এক বিশাল স্বস্তি বয়ে আনতে চলেছে। বর্তমানে প্রচলিত চার স্তরের জিএসটি ব্যবস্থা (৫%, ১২%, ১৮% এবং ২৮%) সরিয়ে দুটি সরল স্তরে আনার পরিকল্পনা করছে কেন্দ্র। এর ফলে একদিকে যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ও পণ্য সস্তা হবে, তেমনি শিল্প ও উৎপাদন খাতের খরচ কমে অর্থনীতির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছে সরকারি খাতের ব্যাঙ্ক ব্যাঙ্ক অফ বরোদা (BoB)।
ব্যাঙ্ক অফ বরোদার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই জিএসটি সংস্কার সরাসরি প্রভাব ফেলবে ভারতের Private Final Consumption Expenditure (PFCE)-এর ১১.৪ শতাংশের উপর। বর্তমানে দেশের করযোগ্য ভোগ ব্যয় আনুমানিক ১৫০-১৬০ লাখ কোটি টাকা, যা কম কর হারের ফলে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ বা কনজাম্পশন তৈরি করতে পারে। এর প্রভাবে আর্থিক বর্ষ ২০২৫-২৬-এর দ্বিতীয়ার্ধে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়তে পারে ০.২ থেকে ০.৩ শতাংশ।
প্রস্তাবিত সংস্কারে ১২ শতাংশ করহার কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হবে এবং সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ করহার নামিয়ে আনা হবে ১৮ শতাংশে। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশে গড়ে কার্যকরী জিএসটি হার নেমে আসবে প্রায় ১৪-১৫ শতাংশে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ধরনের সরল কাঠামো ভোক্তাদের জন্য স্বচ্ছতা বাড়াবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা সহজতর করবে।
খাদ্যপণ্যের উপর কর কমার ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে সাধারণ পরিবার। দুধ, পনির, ভোজ্যতেল, চিনি, মিষ্টান্ন ও প্রসেসড ফুড জাতীয় দ্রব্য ৫ শতাংশ হারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এ খাতে সরাসরি সঞ্চয় হবে। এতে পরিবারের দৈনন্দিন বাজেটে স্বস্তি মিলবে এবং খাদ্যসামগ্রীর ভোগ বাড়বে।
অখাদ্য পণ্যের মধ্যে ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন, এয়ার কন্ডিশনার, ডিশওয়াশার এবং মোটর গাড়ির মতো ভোগ্যপণ্য এখনকার ২৮ শতাংশের বদলে ১৮ শতাংশ হারে করযোগ্য হবে। এর ফলে দাম কিছুটা কমতে পারে এবং ক্রেতারা উৎসাহিত হয়ে নতুন কেনাকাটায় এগোবেন। ব্যাঙ্ক অফ বরোদার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভোক্তা টেকসই পণ্য খাতে চাহিদার বৃদ্ধি গত এক বছরে ১০.৭ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ২.৬ শতাংশে। এই জিএসটি সংস্কার সেই খাতকে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেবে।
শুধু ভোক্তাই নয়, শিল্প খাতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সিমেন্ট, টায়ার, অটো পার্টসের মতো জিনিসে কর কমায় নির্মাণ ও উৎপাদন খাতের খরচ কমবে। এতে চূড়ান্ত পণ্য ও পরিষেবার দামও হ্রাস পাবে, যা দীর্ঘমেয়াদে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হবে। রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের ভোক্তা মূল্য সূচক (CPI) ঝুঁড়ির ৮.৫ শতাংশ এ পরিবর্তনের প্রভাব ফেলবে। ফলে মূল মুদ্রাস্ফীতি ও পাইকারি মূল্য সূচকও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে।
এই আর্থিক সংস্কারের সময়টিকেও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে BoB। সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (RBI) ধারাবাহিকভাবে ১০০ বেসিস পয়েন্ট রিপো রেট কমিয়েছে। সুদের হার হ্রাস ও জিএসটি কাঠামো সহজীকরণ মিলিতভাবে বাজারে ভোগ বাড়াবে। বিশেষত গাড়ির ঋণ, ব্যক্তিগত ঋণ ও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে বড়সড় চাহিদা তৈরি হবে। অ-ব্যাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও (NBFCs) এই চাহিদা বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ সুবিধা পাবে।
আগামী উৎসবের মরসুমে যখন বাজারে স্বাভাবিকভাবেই কেনাকাটা বাড়ে, তখন এই সংস্কারের ফলে চাহিদার গতি আরও বেড়ে যাবে। বিশেষত ভোগ্যপণ্য ও টেকসই পণ্যের বাজারে বিক্রির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে চলমান অনিশ্চয়তা, বাণিজ্য উত্তেজনা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কের মতো চ্যালেঞ্জের মধ্যে ভারতের এই জিএসটি সংস্কারকে বড় কৌশলগত পদক্ষেপ বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল। ভোগ বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি এটি ভারতের অর্থনীতিকে বৈশ্বিক ধাক্কার বিরুদ্ধে আরও সুরক্ষিত করবে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, জিএসটি কাঠামোর এই বড় পরিবর্তন সাধারণ ভোক্তা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের জন্য সমানভাবে লাভজনক হতে চলেছে। খাদ্যপণ্য সস্তা হবে, টেকসই ভোগ্যপণ্যে আবার চাহিদা বাড়বে, শিল্প খাতের উৎপাদন খরচ কমবে এবং বাজারে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এর ফলে ভারতীয় অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে গতি পাবে, যা বর্তমান বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যে দেশের প্রবৃদ্ধিকে আরও শক্ত ভিত্তি দেবে।