ভারতের মিষ্টি ও নোনতা (নমকিন) শিল্প (Sweets industry) কেবল একটি খাদ্যশিল্প নয়, বরং সংস্কৃতি, উৎসব, সামাজিক আচার এবং প্রতিদিনের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দীপাবলির মিষ্টি থেকে শুরু করে সন্ধ্যার আড্ডায় এক কাপ চায়ের সঙ্গে নোনতা—এই শিল্প কোটি মানুষের জীবিকার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, শিল্পটি দীর্ঘদিন ধরে এক অসঙ্গতিপূর্ণ জিএসটি কাঠামোর ভারে ন্যুব্জ। এই কর ব্যবস্থা ব্যবসাকে নিরুৎসাহিত করছে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে এবং ভোক্তাদের জন্যও দামে প্রভাব ফেলছে। সরকার যখন কর কাঠামো সরলীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তখনই এই খাতের সমস্যাগুলি সমাধান করা সময়ের দাবি।
ভারতে বর্তমানে জিএসটি ৫টি স্ল্যাবে বিভক্ত—০, ৫, ১২, ১৮ এবং ২৮ শতাংশ। কিন্তু খাদ্যসামগ্রী কোন নির্দিষ্ট যুক্তি ছাড়াই ভিন্ন ভিন্ন স্ল্যাবে বিভক্ত করা হয়েছে। এর ফলে তৈরি হচ্ছে অস্বচ্ছতা, বিরোধ এবং অযথা হিসাবরক্ষণ বোঝা। উদাহরণস্বরূপ:
মালাবারি পরোটা’র ওপর কর ১৮ শতাংশ, অথচ রুটি/চাপাটিতে ৫ শতাংশ এবং পাউরুটিতে ০ শতাংশ।
ব্র্যান্ডবিহীন নোনতা ৫ শতাংশ, কিন্তু ব্র্যান্ডেড হলে কর বেড়ে দাঁড়ায় ১২ শতাংশ।
মিষ্টির দোকানে বসে খেলে ৫ শতাংশ কর, তবে প্যাকেট করে নিয়ে গেলে অন্য হারে কর ধার্য হয়।
আধুনিক হাইব্রিড আউটলেট—যেখানে একই রান্নাঘরে মিষ্টি, রেস্টুরেন্টের খাবার ও বেকারি সামগ্রী তৈরি হয়—তাদের জন্য দ্বৈত হিসাবরক্ষণ এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
রেস্টুরেন্ট খাতে কর ৫ শতাংশ হলেও ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট (ITC) পাওয়া যায় না। কিন্তু মিষ্টি বা নোনতা বিক্রির ক্ষেত্রে আলাদা স্ল্যাব ও ক্রেডিট প্রযোজ্য। ফলে একই রান্নাঘর ও একই কর্মী থাকা সত্ত্বেও মালিকদের আলাদা আলাদা খাতা রাখতে হচ্ছে এবং অবিরাম মামলার ঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে।
ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট (ITC) না পাওয়াই এই খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা।
রেস্টুরেন্ট মালিকরা কাঁচামাল, প্যাকেজিং, বিদ্যুৎ, ভাড়া বা অন্যান্য খরচের ওপর প্রদেয় কর ফেরত পান না। এর ফলে খরচ বাড়ছে এবং শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপর চাপ পড়ছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবার, যাদের আয়ের বড় অংশ খাদ্যে খরচ হয়, তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
যদি ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট পুনরায় চালু হয়, তবে করের স্তরে স্তরে চাপ কমবে, ব্যবসায়ীদের কার্যকরী মূলধন মুক্ত হবে এবং স্বচ্ছতা বাড়বে।
এই শিল্প কেবল দোকানের কাউন্টারেই সীমাবদ্ধ নয়; এর প্রভাব কৃষি, কর্মসংস্থান ও রপ্তানির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
দেশের মোট নিবন্ধিত কারখানার ১৬ শতাংশই খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত।
শিল্পটিতে ২১ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন, যা কারখানাভিত্তিক মোট চাকরির ১১ শতাংশ।
গ্রামীণ খাদ্য ব্যয়ের ১০ শতাংশ ও শহুরে খাদ্য ব্যয়ের ১১ শতাংশ আসে প্যাকেটজাত খাবার থেকে।
জিএসটি চালুর পর থেকে পরিবহন খরচ দুই-তৃতীয়াংশ বেড়েছে।
ভারতের মোট রপ্তানির ১৩ শতাংশ খাদ্যপণ্য।
সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে এমএসএমই খাত। অ-ব্র্যান্ডেড নোনতা বিক্রেতারা ৫ শতাংশ কর দিচ্ছেন, অথচ ছোট ব্র্যান্ডেড উৎপাদকরা ১২ শতাংশ করের চাপ বহন করছেন। এতে তাদের মার্জিন নষ্ট হচ্ছে, প্রতিযোগিতা কমছে এবং আনুষ্ঠানিক বাজারে আসার ইচ্ছা কমছে। যদি সব ধরনের নোনতা ৫ শতাংশ স্ল্যাবে আনা যায়, তবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবেন, করভিত্তি বাড়বে এবং বাজার সমান প্রতিযোগিতার হবে।
বিশ্বমানচিত্রে ভারত এই ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে।
৭৪ শতাংশ দেশ খাদ্যপণ্যকে জিএসটি বা ভ্যাট থেকে ছাড় দেয়।
জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও জাপান খাদ্যের করহার ১০ শতাংশের নিচে রেখেছে।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভারতেও খাদ্যের ওপর হালকা করনীতি হওয়া উচিত, যাতে কর্মসংস্থান, কৃষক ও রপ্তানি খাত সুরক্ষিত থাকে এবং ভোক্তাদের জন্য খাদ্য সহজলভ্য হয়।
ভারতের মিষ্টি ও নোনতা শিল্প শুধু অর্থনৈতিক খাত নয়, বরং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক। তাই সরকারের উচিত অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া:
সব ধরনের নোনতাকে ৫ শতাংশ স্ল্যাবে আনা।
মিষ্টির দোকান ও রেস্টুরেন্ট মিলিত আউটলেটগুলিকে একই হারে করের আওতায় আনা।
রেস্টুরেন্ট ও মিষ্টির দোকানগুলিকে ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিটের সুযোগ দেওয়া।
এতে করে হিসাবরক্ষণ সহজ হবে, মামলার ঝুঁকি কমবে, ক্ষুদ্র ব্যবসা টিকে থাকবে এবং ভোক্তারা ন্যায্য দামে প্রিয় খাবার পাবেন।
মিষ্টি ও নোনতা শিল্প ভারতের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজের অপরিহার্য অংশ। জিএসটির অসঙ্গতিপূর্ণ কাঠামো কেবল ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের ক্ষতি করছে না, বরং কর্মসংস্থান ও রপ্তানি ক্ষেত্রকেও প্রভাবিত করছে। এই মুহূর্তে কর কাঠামোর সংস্কার শুধু অর্থনৈতিক প্রয়োজন নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়িত্বও।
সরকার যদি এই খাতকে ৫ শতাংশ স্ল্যাবে নিয়ে আসে এবং ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট পুনঃপ্রবর্তন করে, তবে তা ব্যবসা সহজ করবে, কৃষক থেকে দোকানদার—সবাই উপকৃত হবেন এবং ভারতের প্রিয় মিষ্টি-নোনতা সবার নাগালের মধ্যে থাকবে।