বিদেশে অঘোষিত আয় ও সম্পদের (Black Money) বিরুদ্ধে নেওয়া আইনি পদক্ষেপে কেন্দ্র সরকার এখন পর্যন্ত ২১,৭১৯ কোটি টাকার কর দাবি করেছে এবং ১৩,৩৮৫ কোটি টাকার জরিমানা ধার্য করেছে। রাজ্যসভায় এক লিখিত জবাবে এই তথ্য জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধুরী। এই কর ও জরিমানার পরিমাণ ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে করা মূল্যায়নের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছে।
তবে এই বিপুল অর্থের দাবির তুলনায় আদায়ের পরিমাণ অনেকটাই নগণ্য। চৌধুরীর মতে, এই সময়কালের মধ্যে কালো টাকা (অঘোষিত বিদেশি আয় ও সম্পদ) আইন অনুযায়ী কর, জরিমানা ও সুদের ভিত্তিতে মোট ₹৩৩৮ কোটি টাকাই এখন পর্যন্ত আদায় করা গিয়েছে।
কালো টাকা আইনের আওতায় মামলা ও তদন্ত:
২০১৫ সালে ‘The Black Money (Undisclosed Foreign Income and Assets) and Imposition of Tax Act’ প্রণয়ন করা হয়, বিদেশে গোপনে রাখা সম্পদ ও আয়কে চিহ্নিত করে তাদের উপর কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য। মন্ত্রী জানিয়েছেন, এই আইনের বিভিন্ন ধারায় এ পর্যন্ত ১৬৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং তদন্তকার্য এখনো চলছে।
তবে এইসব কর ও জরিমানার দাবি কোন দেশ বা বিদেশি সম্পদের কী ধরনের হোল্ডিংয়ের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে, তার কোনও দেশভিত্তিক তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে রক্ষিত হয় না। অর্থাৎ, কোন নির্দিষ্ট দেশের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বা সম্পদের ভিত্তিতে কত টাকা দাবি উঠেছে বা আদায় হয়েছে — এ ধরনের তথ্য আলাদা করে সরকারের কাছে নেই।
সুইস ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত বিভ্রান্তি:
গত বছর কিছু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ভারতীয় সংযোগযুক্ত তহবিলের পরিমাণ সুইস ব্যাঙ্কে বেড়েছে বলে দাবি করা হয়। এ বিষয়ে মন্ত্রী স্পষ্ট করেন যে, এই তথ্য শুধুমাত্র সুইস ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের (SNB) সাধারণ পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হয়েছে এবং সেগুলো আসলে ভারতীয় নাগরিকদের প্রকৃত আমানতের প্রতিফলন নয়।
চৌধুরীর বক্তব্য অনুযায়ী, SNB-এর বার্ষিক পরিসংখ্যান কাস্টমার ডিপোজিট, অন্যান্য দায়বদ্ধতা এবং ব্যাঙ্কগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক লেনদেনের তথ্য একত্রিত করে প্রকাশিত হয় — যা অনেক সময় সুইস ব্যাঙ্কের বিদেশি শাখাগুলির কার্যক্রমকেও অন্তর্ভুক্ত করে। ফলে, এসব সংখ্যার ভিত্তিতে ভারতে কত টাকা সুইস ব্যাঙ্কে রাখা হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।
সুইস কর্তৃপক্ষ নিজে এ বিষয়ে বারবার বলেছে যে, তাদের এই তথ্য ভারতীয় নাগরিকদের দ্বারা সুইজারল্যান্ডে রাখা আমানত মূল্যায়নের জন্য ব্যবহারযোগ্য নয় এবং ভুল ব্যাখ্যার জন্ম দিতে পারে।
সরকার কী বলছে?
সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী, বিদেশে সম্পদ গোপন করে রাখা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালিত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট আয়কর অঞ্চলভুক্ত কর্তৃপক্ষ দ্বারা। তদন্ত ও মামলা করা হচ্ছে কেস বাই কেস ভিত্তিতে এবং একাধিক বিচারব্যবস্থার আওতায় পড়া এইসব মামলার জন্য দেশভিত্তিক আলাদা পরিসংখ্যান তৈরি করা হয় না।
অর্থ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই আইন অনুযায়ী কর নির্ধারণ এবং জরিমানা চাপানোর কাজ চলমান। তবে আদায়ের ক্ষেত্রে যেসব বাধা রয়েছে, সেগুলি দূর করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সরকারের মতে, অঘোষিত বিদেশি সম্পদের বিরুদ্ধে এই কঠোর আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা বিদেশে বেআইনি আর্থিক কার্যকলাপ দমন করতে সহায়ক হবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ:
যদিও কর ও জরিমানার মোট পরিমাণ প্রায় ₹৩৫,০০০ কোটির কাছাকাছি, তবে মাত্র ₹৩৩৮ কোটি আদায় হওয়া প্রশ্ন তোলে এই আইনের কার্যকারিতা নিয়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জটিলতা, তথ্য বিনিময় সংক্রান্ত চুক্তি, এবং আইনি লড়াইয়ের দীর্ঘসূত্রতা — সবই এই আদায় প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তোলে।
ভারত সরকার যদিও বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে অটোমেটিক ইনফরমেশন এক্সচেঞ্জ (AEOI) চুক্তিতে আবদ্ধ, তবে বাস্তবে এই তথ্যগুলিকে রূপান্তর করে ট্যাক্স আদায়ে পরিণত করা বেশ সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন একটি প্রক্রিয়া।
সুইস ব্যাঙ্কে টাকা রাখার কালো গল্প অনেকদিন ধরেই জনমানসে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হল, সরকার যতই কঠোর আইন প্রয়োগ করুক, আদায়ের তুলনায় চিহ্নিত করের পরিমাণ বহু গুণ বেশি থেকে যাচ্ছে। তথ্যের জটিলতা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব এবং দেশভিত্তিক বিশ্লেষণের অভাবে এই প্রচেষ্টার পূর্ণ সুফল এখনো পাওয়া যায়নি।
তবুও, সরকারের সদিচ্ছা এবং সক্রিয়তা প্রমাণ করে যে, কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই থেমে নেই — এবং ভবিষ্যতে আরও প্রযুক্তি নির্ভর এবং আন্তর্জাতিক সমন্বয় ভিত্তিক পদক্ষেপের দিকেই এগোচ্ছে ভারত।