কেন্দ্রীয় সরকার সোমবার লোকসভায় ফিনান্স বিল ২০২৫-এর ৫৯টি সংশোধনীর মাধ্যমে অনলাইন বিজ্ঞাপনের ওপর আরোপিত ইকুয়ালাইজেশন লেভি বা ডিজিটাল কর (Equalisation Levy) তুলে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাব বর্তমানে লোকসভায় আলোচনাধীন রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদক্ষেপ আমেরিকার সঙ্গে সমঝোতার একটি ইঙ্গিত হতে পারে, যারা এই করের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছে। আমেরিকা ঘোষণা করেছে, এই কর অব্যাহত থাকলে তারা আগামী ২ এপ্রিল থেকে প্রতিশোধমূলক শুল্ক চাপাতে পারে।
ইকুয়ালাইজেশন লেভি প্রথম চালু হয়েছিল ২০১৬ সালের ১ জুন। এটি মূলত অনলাইন বিজ্ঞাপন পরিষেবার ওপর ৬ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হয়েছিল, যা ভারতে ব্যবসা না করা বিদেশি ডিজিটাল কোম্পানিগুলোকে লক্ষ্য করে। গুগল, ফেসবুকের মতো বৈশ্বিক টেক জায়ান্টদের জন্য এই কর গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যারা ভারতীয় বাজার থেকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিপুল আয় করলেও এখানে স্থায়ী কার্যালয় না থাকায় ঐতিহ্যবাহী কর ব্যবস্থার আওতায় পড়ত না। এই লেভির উদ্দেশ্য ছিল ডিজিটাল অর্থনীতির সমতা বজায় রাখা এবং দেশীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারসাম্য আনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই লেভি তুলে নেওয়ার প্রস্তাবের পিছনে আমেরিকার চাপ একটি বড় কারণ। আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে এই করের বিরোধিতা করে আসছে, দাবি করে যে এটি তাদের কোম্পানিগুলোর ওপর অযৌক্তিকভাবে লক্ষ্য করা হয়েছে। গত বছর মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি (USTR) এই লেভিকে ‘বৈষম্যমূলক’ বলে অভিহিত করে ভারতের বিরুদ্ধে বাণিজ্য শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে উত্তেজনা এড়াতে এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের ডিজিটাল মার্কেটিং ও ছোট ব্যবসায়ীদের মধ্যে এই খবরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কলকাতার একজন ডিজিটাল বিজ্ঞাপন ব্যবসায়ী বলেন, “এই লেভি তুলে নিলে গুগল, ফেসবুকের মতো কোম্পানিগুলোর জন্য খরচ কমবে। কিন্তু আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য এটি প্রতিযোগিতা আরও কঠিন করে তুলতে পারে।” অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করছেন, এটি ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নত করতে সাহায্য করবে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য ভালো।
লোকসভায় ফিনান্স বিল ২০২৫-এর আলোচনার সময় এই প্রস্তাবটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ এই সংশোধনীগুলো উপস্থাপন করেছেন, যার মধ্যে ইকুয়ালাইজেশন লেভি তুলে নেওয়া অন্যতম। তবে, এই প্রস্তাবের বিরোধিতাও হচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর একাংশ দাবি করেছে, এই লেভি তুলে নিলে সরকারের রাজস্ব আয়ে ঘাটতি হবে। ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে এই লেভি থেকে সরকার প্রায় ৩,০০০ কোটি টাকা আয় করেছিল। বিরোধীরা বলছেন, “এই টাকা দেশের উন্নয়নে ব্যবহার হতো। আমেরিকার চাপে এটি তুলে নেওয়া মানে নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া।”
এই প্রস্তাব গৃহীত হলে ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি বিদেশি টেক কোম্পানিগুলোকে ভারতীয় বাজারে আরও বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে পারে। তবে, দেশীয় কোম্পানিগুলোর জন্য প্রতিযোগিতা বাড়বে, এবং সরকারকে বিকল্প রাজস্ব উৎস খুঁজতে হবে। একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, “এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। ভারত যদি আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ভালো রাখতে চায়, তবে এই ধরনের ছাড় দিতে হবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা দরকার।”
অনলাইন বিজ্ঞাপনের ওপর ইকুয়ালাইজেশন লেভি তুলে নেওয়ার প্রস্তাব ফিনান্স বিল ২০২৫-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিক নির্দেশ করতে পারে। বাঙালি ব্যবসায়ী ও প্রযুক্তিপ্রেমীদের জন্য এটি একটি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। লোকসভায় এই প্রস্তাব পাস হলে, ভারতের ডিজিটাল ল্যান্ডস্কেপে কী পরিবর্তন আসে, সেদিকে নজর থাকবে সবার।